ইউপি নির্বাচন ও জমিদারির পুনরুত্থান

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


ইউপি নির্বাচনের ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব আরও কিছুদিন পর। পঞ্চম পর্ব মাত্র শেষ হলো। আগের পর্বগুলোর মতোই সর্বশেষ পঞ্চম পর্বের আগে ও পরে সংবাদমাধ্যম ছেয়ে গেছে হানাহানির খবরে। কোথায় কতজন মারা গেল, কতজন আহত হলো, কোথায় লুটপাট, ভাঙচুর, বাড়িতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, হামলা ইত্যাদির প্রতিবেদন। যত দূর মনে পড়ে, প্রথম এক বা দুই পর্বে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাগুলি ইত্যাদির খবর খুব বেশি ছিল না। পঞ্চম পর্ব নাগাদ গোলাগুলি বেড়েছে, কোথাও কোথাও থানা ঘেরাও হয়েছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। তাই ধারণা করছি ষষ্ঠ ও শেষ পর্বে ‘উন্নয়নের’ এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। নিঃসন্দেহে এসব কারও কাম্য নয়, তবু আশঙ্কা এই অদ্ভুত অগ্রযাত্রার।

কয়েক মাসব্যাপী চলমান এই সব হানাহানি নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণও চলছে। এত কিছুর মধ্যেও একটা অনড় ব্যাপার আছে, যা কিছুই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশন তার বক্তব্যে অনড়। অনেকটা শামসুর রাহমানের কবিতার মতো, ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহংকার। বেজায় টলছে মাথা…তবু ঠিক রয়েছি দাঁড়িয়ে।’ অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের একই বক্তব্যের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তিই চলছে।

অন্যরা বলছেন সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের কথা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা, সরকারি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি ইত্যাদি। তবে আমি এই সব হানাহানির কারণ খুঁজতে নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায় দ্বারস্থ হব ইতিহাসের। কারণ বর্তমান কালের বদৌলতে আমাদের ইতিহাস এখন শুরু হয় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে আর শেষ হয় ১৯৭১-এর স্বাধীনতায়। অবশ্য কিছুটা আগে-পরেরও ব্যাপার আছে। কিন্তু সেটাও সীমাবদ্ধ। আমার কিচ্ছা এসবের বহু দশক ও শতাব্দীর পূর্বের ইতিহাস ঘিরে। সে ইতিহাস বয়ানে বিচ্যুতি হলেও সেটা ইতিহাস বিকৃতির আওতার বাইরে থাকবে বলেই ধরে নিচ্ছি। হঠাৎ মুরব্বি ও পণ্ডিত ঐতিহাসিকদের নজরে যদি এই লেখা পড়েও যায়, তাঁরা কেবল ভ্রুই কুঁচকাতে পারেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর গেল রে গেল রে বলে হইহুল্লোড় করবেন না।
২.

ফিরে তাকাই জমিদারি আমলের দিকে। অনেক জমিদারের বংশধর হয়তো ভীষণ নাখোশ হবেন, যদি বলি যে এই বাংলায় দু-চারটি হাতে গোনা ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালি সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে তেমন জমিদার ছিল না। আমরা জমিদারি করতে পারিনি। আমাদের ভূখণ্ডের অন্তত তিন-চতুর্থাংশ বা তারও বেশি জমিদার ছিলেন বাঙালি-হিন্দু। বাঙালি হিন্দু জমিদারেরা ১৯৪৮ সাল থেকে ভারতে গমন শুরু করেন। ১৯৫০-এ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর এই প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত ত্বরান্বিত হয়। অবশ্য সুযোগও সৃষ্টি হয়েছিল, কেননা আইনটি ১৯৫০-এ পাস হলেও কার্যকারিতা পায় ১৯৫৬ সালে। বাকি থাকল অন্য জমিদারদের কথা। তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন শিয়া মুসলমান। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো ঢাকার নওয়াব পরিবার। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না যে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাও ছিলেন শিয়া মুসলমান। তাঁর পরের নবাব মীর জাফর অবশ্য বাঙালি ছিলেন না, তাঁর জন্ম ইরাকে। আজকালকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার মতোই প্রবাসী ইরাকি মীর জাফর অধিক আয়ের আশায় কিশোর বয়সেই ভারতগামী হয়েছিলেন এবং শেষ ঠিকানা গাড়েন বাঙাল মুলুকের নবাব রূপে। সুন্নিদের মধ্যে অবশ্যই কিছু কিছু জমিদার ছিলেন, তবে কোথায় ছিলেন, কখন ছিলেন আর কত বড় জমিদার ছিলেন, তার বিশদ খোঁজখবর রাখার বয়ান আমার খুব একটা নজরে পড়েনি। করজোড়ে স্বীকার করছি, এই অঞ্চলের জমিদারি নিয়ে পড়াপড়ি করেছিলাম তিন দশক আগে, ইদানীংকালের ঐতিহাসিকদের জমিদারিসংক্রান্ত লেখালেখির খবর এখন আর রাখি না।

আমাদের মানসে জমিদারগিরির যে কল্পচিত্র গেঁথে আছে, তার প্রায় প্রধান উৎস হলো সিনেমা আর নাটক। প্রয়াত শ্রদ্ধেয় হ‌ুমায়ূন আহমেদের সিনেমা চন্দ্রকথা এবং তাঁর শেষ সিনেমা ঘেটুপুত্র কমলাতেও ছিল জমিদারি শানশওকতের চিত্র। ভাওয়ালের রাজবাড়ি এখনো গাজীপুরের প্রধান সরকারি ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই ভাওয়াল রাজার মেজ কুমার, অর্থাৎ মেজ পুত্রকে নিয়ে দুই-তিন বছর আগে কলকাতায় নির্মিত হয়েছিল এক যে ছিল রাজা নামের সিনেমা। সিনেমাটির প্রথম আধা ঘণ্টার বেশি ছিল জমিদারি শানশওকতের সেই একই চিত্র। সিনেমাটি দেখা দর্শকেরা নিশ্চয়ই জানেন, ওই সিনেমায় আমাদের জয়া আহসানের অভিনয়ের কথা।

মোদ্দাকথা, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে জমিদারদের সংখ্যা ছিল বেশ অল্প। কিন্তু তাঁদের জৌলুশ, ভাবসাব, জমিদারি আচার-আচরণের সঙ্গে আমরা পরিচিত আমাদের সাহিত্য, ভারতীয় ও দেশি সিনেমা ও নাটকের কল্যাণে। তাঁদের অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর দিকগুলো এবং লাঠিয়াল বাহিনী ও তার দাপটের ভয়াবহ রূপও আমাদের অজানা নয়। আগেকার জমিদারদের লাঠিয়ালদের ঘরে বসে থাকার জন্য পোষা হতো না। বর্তমানে মোটরসাইকেল বাহিনীকেও বসিয়ে রাখা হয় না। ভোটযুদ্ধ, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো ও বাধা দেওয়া, হুমকি-ধমকি এবং আনুষঙ্গিক বহু কাজে তাদের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

৩.

এখন অতীতের জমিদারি কিচ্ছা থেকে আসি বর্তমানের ইউপি নির্বাচনের গল্পে। এই ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের সুপ্ত জমিদারির বাসনা উন্মেষ হচ্ছে। জমিদারি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতে গেলে অতীতে যেমন লাগত লাঠিয়াল বাহিনী, তেমনি এখন লাগে শোডাউন। অর্থাৎ মোটরসাইকেল বাহিনী। আগে লাগত চার বা ছয় ঘোড়ার গাড়ি, এখন লাগে আগে-পিছে মাইক্রোবাস আর মাঝখানে বিরাট এসইউভি। আগে জমিদারের অর্থ উপার্জনের জন্য প্রজাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং বিভিন্ন উপলক্ষ আবিষ্কার করে হরেক নামের কর আদায় করার রেওয়াজ ছিল, এখন চেয়ারম্যানের পদ পেলে অর্থের জোগান নিশ্চিত করার বহুবিধ নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার হয়েছে এবং হচ্ছে। দুষ্ট লোকের মুখে শুনেছি জন্মনিবন্ধন সনদের হার বিভিন্ন ইউনিয়নে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। অর্থাৎ অর্থ জোগান শুরু করা যায়, নতুন প্রজার জন্মের প্রথম দিন থেকেই।

আগেকার জমিদারদের লাঠিয়ালদের ঘরে বসে থাকার জন্য পোষা হতো না। বর্তমানে মোটরসাইকেল বাহিনীকেও বসিয়ে রাখা হয় না। ভোটযুদ্ধ, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো ও বাধা দেওয়া, হুমকি-ধমকি এবং আনুষঙ্গিক বহু কাজে তাদের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগে যেমন লাঠিয়াল ছাড়া জমিদারি কল্পনাও করা যেত না, তেমনি আজকাল নিবেদিত কর্মী-যোদ্ধা বাহিনী না থাকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বোধ হয় চিন্তাও করা যায় না। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। দুই-চারটি ব্যতিক্রম কখনোই মূল নীতি বা রীতিকে ভ্রষ্ট করে না।

উপনিবেশবাদের শেষে, নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর যেখানেই কর্তৃত্ববাদী সরকার জেঁকে বসেছে, সেখানে রাজনীতির বিকাশ কমবেশি একটা সরল ও সোজা রাস্তা ধরে চলেছে। প্রথমে সামরিক বাহিনীর ওপরে নির্ভরশীলতা, পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ওপরে ভরসা, তারপর চাই বা না চাই, দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট স্থানীয় কর্তৃত্ববাদী সংগঠন বা গোষ্ঠী। অনেক দেশে অপরাধী চক্র তাদের নিজ নিজ স্থানে কেন্দ্রীয় সরকারকে উপেক্ষা করেই নিজেদের জমিদারি সীমানা করেছে। যেহেতু আমাদের অঞ্চলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরু হয়েছিল প্রায় এক শ বছর আগে, সেহেতু এই কর্তৃত্ববাদের যুগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে উঠেছে স্থানীয় কর্তৃত্ব গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে। মাদক বা অন্যান্য অপরাধী চক্রের প্রভাব এই অঞ্চলে কখনোই ব্যাপক ছিল না, তাই সে পথে না গিয়ে আমরা ধরেছি জমিদারি জৌলুশের পথ। এখন কর্মীরা লাঠিয়াল, অনিবার্য ফলাফল হানাহানির ব্যাপকতা।

দেশে নব্য জমিদারদের উত্থান হচ্ছে। প্রায় দেশেই যেটা হয়েছে, আশঙ্কা হয় আমাদেরও সেটাই হবে। অর্থাৎ স্থানীয় নব্য জমিদারেরা কেন্দ্রকে উপেক্ষা করতে শুরু করবেন এবং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতর হয়ে পড়বে। থানা ঘেরাও শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের বাইরে স্থানীয় নব্য জমিদারেরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় স্বীয় কর্তৃত্ব কায়েম করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তাঁদের লাঠিয়াল বাহিনীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব নির্বাচনের পরও বহাল থাকবে এবং বাড়বে, এমনই আশঙ্কা করছি।

লেখক: ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *