ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযমের আপিল মামলা আদেশের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায় এসেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক নম্বর কোর্টের মঙ্গলবারের (২৪ ফেব্রুয়ারি) কার্যতালিকায় দুই নম্বরে আদেশের জন্য মামলাটি দেখা গেছে। এর আগে গোলাম আযমের মৃত্যুর কারণে আপিল মামলাটি অকার্যকর হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, মৃত্যুর পর কারও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার বিধান নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই আপিল মামলাটি অকার্যকর হয়ে যাবে।
এর অাগে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আব্দুল আলীম মারা যাওয়ায় তার আপিল মামলাটিও অকার্যকর ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ।
৯২ বছর বয়সী গোলাম আযম গত বছরের ২৩ অক্টোবর রাতে দণ্ড ভোগরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) মারা যান। অসুস্থতার কারণে রায়ের আগে থেকেই ওই হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে বিচার করা হয়। রায়ের পরও সেখানে থেকেই যুদ্ধাপরাধের সাজা খাটছিলেন তিনি।
গত বছরের ২৫ অক্টোবর দুপুরে গোলাম আযমকে দাফন করা হয় রাজধানীর মগবাজার পারিবারিক গোরস্থানে।
গোলাম আযমের রায় ও আপিল
২০১৩ সালের ১৫ জুলাই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ ধরনের ৬১ অপরাধের দায়ে গোলাম আযমকে ৯০ বছরের শাস্তির আদেশ দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। তবে বয়স বিবেচনা করে গোলাম আযমকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ না দিয়ে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, গোলাম আযম মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য। তিনি সবকিছুর জন্য দায়ী। তিনি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করেছিলেন। তাদের তিনি অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারতেন। কিন্তু সজ্ঞানে তিনি তা করেননি। তার বয়স ৯১ বছর। শুধুমাত্র এই বিবেচনা করেই এ রায় দেওয়া হলো।
একই সঙ্গে রায়ে জামায়াতকে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন বলে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ছয়টি, সহযোগিতা সংক্রান্ত তিনটি, উস্কানির ২৮টি, সম্পৃক্ততার ২৩টি এবং ব্যক্তিগতভাবে হত্যা-নির্যাতনের ১টিসহ মোট ৬১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।
মামলার রায়ে এ ৬১টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল এ পাঁচ ধরনের অভিযোগের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগে ১০ বছর করে, তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে ২০ বছর করে ও পঞ্চম অভিযোগে ৩০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন গোলাম আযমকে। এ সাজা তিনি একাধারে ভোগ করবেন বলেও রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া ৯০ বছরের এ কারাদণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট আপিল বিভাগে আপিল করে খালাস চেয়েছিলেন গোলাম আযম। অন্যদিকে পরদিন ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের সাজা অপর্যাপ্ত উল্লেখ করে তার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও জামায়াত নিষিদ্ধের আরজি জানিয়ে আপিল করেছিলেন রাষ্ট্রপক্ষ।
মৃত্যুতে অকার্যকর আলীম-ইউসুফের মামলা
এর আগে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম মারা যাওয়ায় তার আপিল মামলাটি অকার্যকর ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। দণ্ড ভোগরত অবস্থায় গত বছরের ৩০ আগস্ট মারা যান এই যুদ্ধাপরাধী। এ কারণে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের আপিল বিভাগ আপিলটি অকার্যকর ঘোষণা করেন।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যার ৯টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। তবে গোলাম আযমের মতোই শারীরিক-মানসিক অক্ষমতার কারণে ৮৬ বছর বয়সী আলীমেরও মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে লঘু সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেছিলেন আলীম।
অন্যদিকে বিচার চলাকালে মারা যাওয়ার কারণে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে মামলা আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২। মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা একেএম ইউসুফের মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে ছিল। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়ে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি মামলার শেষ ধাপ যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এর আগে ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যাওয়ায় ওই দিন ট্রাইব্যুনাল এ মামলা নিষ্পত্তির আদেশ দেন।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের পর স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে প্রথমবারের মতো এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে। ওই রাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত আবদুল কাদের মোল্লাকে। এ চূড়ান্ত রায়টি এসেছিল আপিল বিভাগ থেকে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ৫ ডিসেম্বর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
এর আগে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিলে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ। আপিলের চূড়ান্ত রায়ে সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের কার্যক্রম
গোলাম আযম, আলীম ও কাদের মোল্লা ছাড়াও আরও নয়টি মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে আপিল বিভাগে।
এর মধ্যে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনও প্রকাশিত হয়নি।
ট্রাইব্যুনাল-২ এর রায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার শুনানি শেষ হয়েছে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। এরপর গত বছরের ৩ নভেম্বর বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ায় এ আপিল মামলাটি এখন রিভিউ আবেদনের পর্যায়ে রয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও জামায়াতের সাবেক রোকন মোবারক হোসেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের সাত আপিল মামলার শুনানি শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।