কানাডায় আশ্রয় না পেয়ে দেশে ফিরে আসা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান আত্মগোপনে আছেন। বিমানবন্দর থেকে চুপিসারে বের হওয়ার পর আর তার দেখা মিলছে না। তিনি কোথায় অবস্থান নিয়েছেন তাও স্পষ্ট নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, মুরাদ হাসান জটিলতা এড়াতে রোববার রাতেই তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে যান।
গতকাল তার ধানমন্ডির বাসায় গেলে জানা যায় যে, তিনি বিদেশ থেকে দেশে এসে নিজ বাসায় ফিরেননি। বাসার নিরাপত্তারক্ষী ও কেয়ারটেকারসহ ওই বাসার লোকজন তার কোনো খোঁজ দিতে পারেননি। গতকাল তার অবস্থান কোথায় ছিল তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, তিনি বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে উত্তরায় এক আত্মীয়ের বাসায় যান। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে তিনি চট্টগ্রামের হালিশহরের উদ্দেশে রওনা হন।
ওই এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাড়ি রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালেও তিনি চট্টগ্রামের হালিশহরে যেতেন। ধানমন্ডির বাসার নিরাপত্তারক্ষী সুমন জানান, স্যার (মুরাদ হাসান) বাসায় নেই। তিনি কেথায় আছেন প্রশ্ন করা হলে জানান, স্যার বিদেশ থেকে আসার পর বাসায় আর আসেননি। তিনি কোথায় আছেন তিনি তা জানেন না।
বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে দেশ ছেড়েছিলেন মুরাদ। কিন্তু কানাডায় ও দুবাইয়ে আশ্রয় না পাওয়ায় তিনি আরও বেশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। দেশে ফিরে আসাটা তার জন্য বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া ইতিমধ্যে বেশকিছু স্থানে তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে। যদিও গতকাল দু’টি মামলার আবেদন আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। তবে কোথাও মামলা গ্রহণ করা হলে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। নতুন করে আর যাতে জটিলতা তৈরি না হয় এজন্য নিজেকে আড়ালেই রাখতে চাইছেন ডা. মুরাদ।
ফেসবুক লাইভ টকশোতে নারী বিদ্বেষী বক্তব্য প্রদান এবং চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় ধর্ষণের হুমকি প্রদানের অডিও ক্লিপ ভাইরাল হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত সপ্তাহে (৭ই ডিসেম্বর) মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ডা. মুরাদ হাসান। এরপর গত বৃহস্পতিবার দেশ ছেড়ে কানাডার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। গত রোববার সন্ধ্যায় দুবাই বিমানবন্দর থেকে রোববার সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৫৮৬ ফ্লাইটে দেশে ফিরেন তিনি। সেটি শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। অবতরণের নির্ধারিত সময় ছিল বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিট। কানাডায় প্রবেশের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুবাইয়ে ফিরে আসেন ডা. মুরাদ। সেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সংগ্রহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ দেশের ৪ টি জেলায় তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে।
মুরাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় সাইবার নিরাপত্তা মামলা খারিজ
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করায় ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা খারিজ করে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বিকালে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত মামলা গ্রহণ করার মতো ‘উপাদান না থাকায়’ খারিজের আদেশ দেন। আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার মানবজমিনকে বলেন, মামলাটি আমলে নেয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান ছিল। কিন্তু বিচারক মামলাটি গ্রহণ করেননি।
ফেসবুক লাইভে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিয়া পরিবার এবং ব্যারিস্টার জাইমা রহমান সম্পর্কে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ, নারী বিদ্বেষী এবং যেকোনো নারীর জন্য মর্যাদাহানিকর ভাষা’ ব্যবহার করার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৫/২৯/৩১/৩৫ ধারার অপরাধ করেছেন বলে এই মামলা দায়ের করা হয়।
এর আগে গতকাল সকালে বিচারক মামলার বাদী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারুকী জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি শেষে মামলাটি গ্রহণের মতো কোনো উপাদান না থাকায় তা খারিজ করে দেন আদালত। তার আগে গত রোববার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের সেরেস্তায় এ মামলার আবেদন করা হয়। আবেদনে মুরাদ ছাড়াও মুহাম্মদ মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদ (নাহিদ রেইন্স) কে আসামি করা হয়। পরে ওমর ফারুক ফারুকীর আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার মানবজমিনকে বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় আপত্তিকর মন্তব্যে এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ, অশালীন ও অবমাননাকর বক্তব্যের জেরে এ মামলার আবেদন করা হয়েছে।
মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, মুরাদ হাসান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ও নাহিদ ডিজিটাল মিডিয়া উপস্থাপক। নাহিদ গত ১লা ডিসেম্বর মুরাদের সাক্ষাৎকার নেন, যা পরে মুরাদ হাসান তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেন। সাক্ষাৎকারে মুরাদ উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিয়া পরিবার এবং ব্যারিস্টার জাইমা রহমান সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ, নারী বিদ্বেষী এবং যেকোনো নারীর জন্য মর্যদাহানিকর ভাষা ব্যবহার করেন। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ফলে সমাজে তথা রাষ্ট্রের সব মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
রাজশাহীতেও মুরাদের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, ঢাকার পর এবার সাবেক তথ্য ও সমপ্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান ও মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল। গত রোববার বিএনপি’র বগুড়া জেলা শাখার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক একেএম সাইফুল ইসলাম মামলাটি দায়ের করেন। তবে ট্রাইব্যুনালের বিচারক জিয়াউর রহমান মামলাটি খারিজ করার আগে মামলার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের ৩টি পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর ইসমত আরা।
তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তে আসার আগে বিচারক আবেদনকারীর বক্তব্য রেকর্ড করেছেন, একটি ভিডিও ক্লিপ দেখেছেন, আদালতে দেয়া মামলার অন্যান্য নথি এবং আইনজীবীদের কথা শুনেছেন।’ পাবলিক প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ইসমত আরা বলেন, প্রথমত বিচারক দেখেছেন যে মামলার আবেদনকারীর কোনো ‘লোকাস স্ট্যান্ডি’ নেই। যার অর্থ এ মামলা দায়ের করার কোনো অধিকার বা ক্ষমতা তার নেই।
আবেদনকারী সাইফুল ইসলাম তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে মামলাটি দায়ের করেন। তবে ভিডিও ক্লিপে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মন্তব্য রাজনৈতিক নয় দেখা গেছে। ‘মন্তব্যটি ব্যক্তিগত আলাপের সময় উঠে এসেছে, এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতিকার চেয়ে মামলা করার অধিকার আছে,’ বলে আদালতের আদেশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন তিনি।
‘দ্বিতীয়ত বিচারক পর্যবেক্ষণ করেছেন যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা অবশ্যই শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা করতে পারে। ব্যক্তিগত কোনো পক্ষ নয়।’ ‘আবেদনকারী তার মামলার বর্ণনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অপরাধ সংঘটনের পর মামলা দায়েরের দিন পর্যন্ত ১৩ দিন অতিবাহিত হলেও কোনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির ঘটনার উল্লেখ করেননি।’
‘বিচারকের তৃতীয় পর্যবেক্ষণ, মামলা দায়ের করা ছিল একটা “অপকৌশল”, যা মেনে নেওয়া উচিত নয়।’ আদালত সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছে যে, এই আইনের অধীনে একই ঘটনায় একই ব্যক্তিদের আসামি করে খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আদালতের আদেশের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসমত আরা বলেন, ‘একই ইস্যুতে একাধিক মামলা দায়ের করা এবং একাধিক জেলায় একই ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা অবশ্যই আইনের লঙ্ঘন। এই ধরনের কর্মকাণ্ড জনগণের অর্থ এবং সময়ের ক্ষতি করবে এবং আইনি ব্যবস্থার অপব্যবহার করবে।’
একটি ফেসবুক লাইভে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় ক্ষুব্ধ হয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। মামলার আবেদনকারী একেএম সাইফুল ইসলাম জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বগুড়া জেলা শাখার উপদেষ্টা। মামলায় তিনি মুরাদ হাসান ও টকশো উপস্থাপক মহিউদ্দিন হেলালকে আসামি করেন।