দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল। পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত বর্তমান এই চলনবিলের মাঠ ঘাট এখন সরিষা ফুলের হলদে আভা ছড়াচ্ছে। যে দিকে চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। এই হলদে ফুলের সমারোহের মধ্যে বসানো হয়েছে মৌবাক্স। ফুলে ফুলে গুনগুন শব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য মৌমাছির দল। এরপর মধু সংগ্রহ করে বক্সে গিয়ে জমাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি এসব বাক্স থেকে খামারিরা মধু সংগ্রহ করে থাকেন। এরপর তা বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন কোম্পানির কাছে। তারা এই মধু প্রসেসিং করে বিক্রি করেন ক্রেতাসাধারণের কাছে। তবে পাইকার তথা কোম্পানির লোকেরা ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষও খামারিদের কাছ থেকে সরিষা ক্ষেতের এই মধু কিনে থাকেন।
চলনবিল অঞ্চলের উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে সরিষা ফুলের হলুদ আভার সৌন্দর্য লক্ষ করা গেছে। এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে শহর থেকে গ্রামে ছুটছেন অনেকে। সুযোগ পেলেই বন্ধুবান্ধব আর পরিবার নিয়েও ঘুরতে বের হচ্ছেন চলনবিলের বিভিন্ন পয়েন্টে। কয়েক মাস আগেও যেখানে পানিতে টইটম্বুর ছিল, সেই চলনবিল এখন সেজেছে হলদে ফুলের অপরূপ সাজে। মাঠের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা সড়কগুলো এর সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা যেমন ছুটছেন, তেমনি ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌ খামারিরা। কারণ সরিষা ফুল থেকে সারা দেশে যে পরিমাণ মধু সংগৃহীত হয়, তার বেশির ভাগই আসে এই চলনবিল অঞ্চল থেকে। চলনবিল অঞ্চলের তিন জেলার (পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর) উল্লাপাড়া, তাড়াশ, শাহজাদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে এবার সরিষা আবাদ হয়েছে বলে স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এসব সরিষা ক্ষেতে পাঁচ শতাধিক মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এসব মৌবাক্সে গড়ে তিন-চারজন করে কর্মচারী কর্মরত।
সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চলনবিলের বাইরের জেলা টাঙ্গাইল, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৌচাষিরা চলনবিলে তাদের মৌবাক্স বসিয়েছেন মধু সংগ্রহের জন্য। গত নভেম্বর থেকে খামারিরা মধু সংগ্রহের জন্য বাক্স স্থাপন করেছেন। তবে পুরোদমে মধু সংগ্রহ শুরু হবে আরো কিছু দিন পর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌ খামারের মাধ্যমে কয়েক শ’ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতি বছর মধু সংগ্রহ করে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকেন।
উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সহসভাপতি আবদুর রশিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, গত বছর চলনবিল অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টনের বেশি মধু সংগ্রহ হয়েছিল। আবহাওয়া ভালো থাকলে এ পরিমাণ বা এর চেয়ে বেশি সংগ্রহ হবে আশা করি। তিনি বলেন, দেড়-দুই মাস আমরা চলনবিলের সরিষা ক্ষেতের মধু সংগ্রহ করব। এরপর আমরা যাবো শরীয়তপুরে। সেখানে কালোজিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে বাক্স বসাব। এরপর আসবে লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহের মৌসুম। প্রথমে নাটোরে এবং এরপর দিনাজপুরে লিচু চাষ এলাকায় বাক্স বসাবো। আবদুর রশিদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার হাটিপাড়া গ্রামে। তিনি সুপরিচিত মধুচাষি, একজন ভালো প্রশিক্ষকও বটে। তিনি আরো জানান, তিনি চলনবিল অঞ্চলের উল্লাপাড়া উপজেলার আলীগ্রামে ৩৭০টি মৌবাক্স স্থাপন করেছেন। এখনো ওইভাবে মধু সংগ্রহ শুরু হয়নি। যতটুকুই হচ্ছে, ক্ষেত থেকে বিভিন্নজন কিনে নিচ্ছেন। বাকিটা জমা করে রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ২০০ টাকা কেজিতে মধু বিক্রি করছি। বিভিন্ন কোম্পানির কাছে এই মধু বিক্রি করে থাকি। গত বছর ছয়-সাত হাজার টাকা মণে মধু বিক্রি করেছি। এবার এখনো তারা দাম বেঁধে দেয়নি।
দেশে সবচেয়ে বেশি সরিষা চাষা হয় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায়। এই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সুবর্ণা ইয়াসমিন সুমি নয়া দিগন্তকে জানান, চলতি রবি মৌসুমে জেলায় ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে চলনবিল অধ্যুষিত উল্লাপাড়া উপজেলাতেই আবাদ হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৮০ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২৬ হাজার ৪৬১ মেট্রিক টন। বারি-১৪, বারি ১৭ ও বারি ১৮ এর সরিষা আবাদ করার পাশাপাশি বিনার নতুন জাতের সরিষার প্রদর্শনীও করা হয়েছে। তিনি জানান, গত বছর উপজেলার ১১০ জন খামারির কাছ থেকে প্রায় ১৫৬ টন মধু সংগ্রহ করা হয়েছিল। আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার এই লক্ষ্যমাত্রা বা তার চেয়ে বেশি অর্জন সম্ভব হবে।
চলনবিলেই হচ্ছে মধু প্রসেসিং প্লান্ট : চলনবিল অঞ্চলে প্রতি বছর শত শত টন মধু সংগৃহীত হলেও প্রসেসিং মেশিন না থাকায় মৌসুমের মধ্যেই তা বিক্রি করতে বাধ্য হন খামারিরা। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কোম্পানিগুলো গিয়ে সরাসরি খামারিদের কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে। তারা যেভাবে দাম নির্ধারণ করে দেন, খামারিদের সেভাবেই বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। ফলে খামারিরা মধুর সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় দীর্ঘ দিন ধরেই চলনবিল অঞ্চলে সরকারিভাবে মধু প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের দাবি ছিল। অবশেষে উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুরে বসছে মধু প্রসেসিং প্লান্ট।
খামারি আবদুর রশিদ বলেন, এখন কোম্পানিগুলো যেভাবে দাম নির্ধারণ করে দেয় সেভাবেই বিক্রি করতে হয়। গত বছর ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা মণ মধু বিক্রি করেছেন খামারিরা। প্রসেসিং প্লান্ট হলে এই মধু ২০ হাজার টাকা মণে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। তবে আবদুর রশিদ মনে করেন সরকারিভাবে এই প্লান্ট যেহেতু হচ্ছে সেটির সিরাজগঞ্জের শিল্প পার্ক এলাকায় হলেই ভালো হতো। উত্তরাঞ্চলের সব খামারির সেখানে যাতায়াত সুবিধা ভালো ছিল।
উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুবর্ণা ইয়াসমিন সুমি জানান, উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুরে মধু প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের সব প্রক্রিয়া শেষ। এই মাসের মধ্যেই মেশিন বসবে আশা করি। উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রজেক্ট থেকে জাইকার অর্থায়নে এটি নির্মিত হচ্ছে। প্লান্টটা হলে চাষিরা লাভবান হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ধরেন তারা এক কেজি মধু ১৮০-২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করে। প্রসেসিং করে বিক্রি করলে তো অনেক বেশি হবে। উত্তরাঞ্চলের চাষিরা সুবিধা পাবে।
উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মওদুদ আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, প্লান্টটি স্থাপনে অবকাঠামো নির্মাণ চলমান। মেশিনারিজ আসবে চায়না থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে প্লান্টটা সম্পন্ন হবে আশা করি। এটি নির্মাণে মেশিনারিসহ ৩০-৩৫ লাখ টাকা লাগছে। কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মধুতে জলীয় উপাদান বেশি থাকলে সেটি বেশি দিন থাকে না। জলীয় উপাদান ২০-২১ শতাংশ থাকলে সেটি এ গ্রেড মধু। ২২-২৩ শতাংশ থাকলে বি গ্রেড এবং ২৪-২৫ শতাংশ জলীয় উপাদান থাকলে সেটি সি গ্রেড। জলীয় উপাদান বেশি থাকলে মধু দীর্ঘ দিন থাকে না, নষ্ট হয়ে যায়। খামারিরা ধরে রাখতে পারে না।
এক মণ মধু রিফাইন করা হলে এক বালতি পরিমাণ পানি বেরিয়ে যাবে, অর্থাৎ উপাদান কমে আসবে। মধুর মূল্যটা বাড়বে। দাম বেশি পাবেন চাষিরা। এই কর্মকর্তা বলেন, পুরো উত্তরবঙ্গে মধু রিফাইনারি প্লান্ট নেই। এটি হলে এই এলাকার খামারিরা লাভবান হবেন। এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। বছরব্যাপী মধু বিক্রি করতে পারবেন চাষিরা। ক্রেতারাও মানসম্পন্ন মধু পাবেন। যেহেতু সরকারিভাবে নির্মিত হচ্ছে তাই প্রসেসিংয়েও বেশি খরচ পড়বে না। তিনি বলেন, তিনতলা ফাউন্ডেশনে বিল্ডিংটা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সেখানে মধু রিসার্চ সেন্টার জাতীয় কিছু করা যাবে।