নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে আগুন, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী। বুধবার দুপুরে কায়েতপাড়ার নাওড়া এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ অভিযোগ করেন। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেন পাটমন্ত্রী।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেন, প্রশাসন শক্ত ভূমিকায় থাকলে এত বড় সহিংস ঘটনা ঘটত না। সন্ত্রাসীরা দীর্ঘ সময় ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে। বাড়িঘর ভাঙচুরের পর লুটপাট করেছে, আগুন দিয়েছে, নৌকার সমর্থকদের মারধর করেছে, তাঁদের ওপর গুলি চালিয়েছে।
পুলিশের ভূমিকা বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো তারা সেখানে ছিল না অথবা তারা নীরব ছিল।
হামলার জন্য কায়েতপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তাঁর ছোট ভাই মিজানুরকে দায়ী করেন পাটমন্ত্রী। মিজানুর তৃতীয় দফা ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন।
গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, নাওড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুরের এলাকা। এ এলাকার লোকজনকে নৌকায় ভোট দিতে নিষেধ করা হয়েছিল। নিষেধ অমান্য করে লোকজন নৌকায় ভোট দিয়েছেন। এ কারণেই বহিরাগত সন্ত্রাসী এনে তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় ১১ নভেম্বরের ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাতের সহিংসতায় দুজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত কায়েতপাড়ার নাওড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ছয়টি বসতঘর ও চারটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। অন্তত ১২টি ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আহত ব্যক্তি সবাই কায়েতপাড়া ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান জায়েদ আলী ও কায়েতপাড়া ১ নম্বর ওয়ার্ডের পরাজিত সদস্য প্রার্থী মোশারফ হোসেনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
মঙ্গলবার রাতে বসতবাড়িতে আগুন দেওয়া হলেও স্থানীয় লোকজন বলছেন, এই বিরোধের সূত্রপাত আগে থেকে। বুধবার অন্তত ২০ গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তৃতীয় দফা ইউপি নির্বাচনে মোশারফ হোসেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জায়েদ আলীর সমর্থক ছিলেন। অপর দিকে কায়েতপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের ভাই মিজানুর রহমান ছিলেন চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। নৌকার পক্ষে কাজ করা নিয়ে রফিকুল ও মিজানুরের সঙ্গে মোশারফের দ্বন্দ্ব হয়। নির্বাচনে জায়েদ আলীর কাছে মিজানুর হেরে যান।
পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। বুধবার দুপুরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকায়
পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। বুধবার দুপুরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো
জায়েদ আলী বলেন, নির্বাচনের পর থেকে নাওড়া এলাকায় অন্তত তিন দফায় মোশারফসহ তাঁর সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে। রফিকুল ও মিজানুরের নির্দেশে কায়েতপাড়া ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে এসব হামলায় বহিরাগত সন্ত্রাসীরা অংশ নিয়েছে।
বুধবার সকালে নাওড়া এলাকায় গিয়ে পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে। দুপুর ১২টায় মোশারফ হোসেনের বাড়িতে তিনটি ঘর পোড়া অবস্থায় দেখা যায়। পোড়া আসবাবপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে ছিল। বাড়ির সামনের অংশে পুলিশ ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। পোড়া ঘরের এক পাশে হামলায় আহত মোশারফের স্ত্রী নূরজাহান বেগমকে ঘিরে স্বজনেরা আহাজারি করছেন।
নূরজাহান বলেন, ‘হঠাৎই আমরা শত শত লোকের চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনতে পাই। তা দেখার জন্য বাড়ির দক্ষিণ পাশে গেলে সেখানেই হামলার শিকার হই। তারা বাড়ির পূর্ব পাশের দেয়াল ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করে সঙ্গে নিয়ে আসা পেট্রল ঢেলে বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে।’
মোশারফের চাচাতো ভাই নবী হোসেন ও আমির হোসেনের বাড়িঘরেও আগুন দেওয়া হয়েছে। বুধবার সকালে আমির হোসেনের ছেলের বউ তাসলিমা আক্তারকে তাঁর দুই শিশুসন্তান নিয়ে পোড়া ঘরের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় পেয়েই কান্না শুরু করেন তিনি। তাসলিমা বলেন, ‘হামলার সময় দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে পাশের শৌচাগারে পালিয়ে ছিলাম। হামলাকারীরা বলেছে, রক্তের হলি খেলা হবে। আবারও হামলা হবে।’ এ সময় অন্তত চারটি বাড়ির দেয়ালজুড়ে শত শত ছোররা গুলির চিহ্ন দেখা যায়।
অভিযোগের বিষয়ে কায়েতপাড়া ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলে মোশারফের লোকজন আমার চাচাতো ভাই আজিজের বাড়িতে আগুন দেয়। তারপর মোশারফের সমর্থকেরা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।’
জানতে চাইলে অভিযুক্ত মিজানুর রহমান বলেন, ‘জায়েদ আলীর সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমাকে এলাকার মানুষ ভালোবাসে। আমরা এখানে শান্তিতে থাকতে চাই।’
বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদ আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেন। পুলিশের অবস্থান নিয়ে মন্ত্রীর করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আমরা জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আটকের জন্য অভিযান চালাচ্ছি।’ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা যাচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে এসপি বলেন, ‘আমরা অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে শুনেছি। অস্ত্রধারীরা বহিরাগত। আমরা অস্ত্রের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি। অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে।’
বুধবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এফ এম সায়েদ বলেন, ভুক্তভোগীরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিযুক্ত ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিনসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।