জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বিবাহ। অথচ এ বিবাহ নিয়েই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ভীতি। এর মূল কারণ স্বল্প আয়, বেকারত্ব ও বিবাহের অনুষ্ঠান খরচ। পিতা-মাতাও হয়ে পড়ছেন অসহায়। সন্তানকে শিক্ষিত করেও পড়েছেন যেন বেকায়দায়। চাকরি পাচ্ছে না। বেকারত্বের গ্লানি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিবাহ দিতে কে চায়? সব মিলিয়ে বিবাহ বাজারে চলছে এক অস্থির দশা।
হাসান শাহরিয়ার। বয়স ৩০ বছর ছুঁই ছুঁই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন। বাড়ি থেকে বিবাহ’র চাপ থাকলেও বিবাহ’র পিঁড়িতে বসা হয়নি তার। হাসান বলেন, “বিবাহ করে ঢাকায় সংসার চালানোর মতো আয় কই? খেয়েদেয়ে কোনোরকম চলছে ব্যাচেলর জীবন। আয়ের কারণে বিবাহ’র কথা ভাবতেই ভয় লাগে।” হাসান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে আমাকে সুযোগও দিয়েছিল কিন্তু সময় মতো চাকরি জোটাতে না পারায় বিবাহ করা হয়নি তাকে।”
ছোট ভাইয়ের বিবাহ হয়েছে তিন বছর আগে। কিছুদিন বাদেই চাচা হবেন শাহরিয়ার খান শুভ। কিন্তু এখনো চাকরি জোটাতে পারেননি তিনি। করা হয়নি বিবাহটাও। শুভ বলেন, “আমার ছোট ভাই এইচএসসি’র পর আর লেখাপড়া করেনি। বাবার ওষুধের ব্যবসায় যুক্ত হয়। এরপর নিজের ব্যবসা। এখন বিবাহ করে সুখেই আছে। আর আমি বিসিএস, সরকারি চাকরি করে সময় কাটাচ্ছি।”
আবার বিবাহতে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আনুষ্ঠানিকতা। নিজের চলার মতো আয় থাকলেও খরচের ভয়ে বিবাহর পিঁড়িতে বসা হচ্ছে না অনেকের। মিজানুর রহমান রাজধানীর একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। বাবা ছিলেন কৃষক। নিজ যোগ্যতায় এসেছেন এই পর্যায়ে। মিজান বলেন, “আমার আয়ে খুব ভালোভাবেই সংসার জীবন শুরু করতে পারবো। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠানের খরচ, গহনা সব মিলিয়ে আমার গুনতে হবে কমপক্ষে তিন থেকে চার লাখ টাকা। আবার বিবাহ হলে তো দুই তিনদিন থাকতে হবে বাড়িতে। বাড়িতে নতুন বউ তোলার মতো অবস্থা নেই। সে কারণেও বিবাহ করার সাহস পাচ্ছি না।” গণমাধ্যমকর্মী মারুফ কিবরিয়া বিবাহর পিঁড়িতে বসেন ৩১ বছর বয়সে। তিনি মনে করেন সঠিক বয়সেই বিবাহ করছেন তিনি। মারুফ কিবরিয়া বলেন, “আমি মনে করি ছেলেদের ২৮ থেকে ৩১ বছর বয়সে বিবাহ করা উচিত। এটাকে সঠিক বয়স বলবো- কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক অবস্থা তাই বলে।” একটা সময় মানুষের জীবনে আসে যখন ধীরে ধীরে বন্ধু বা চেনা পরিবেশটা হারিয়ে যেতে শুরু করে। একাকিত্ব গ্রাস করে। তাই বিবাহটা সেরে নেয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিবাহর চাপটা আসে সাধারণত অনার্স পর্যায় থেকেই। পারিবারিক বিবাহর ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি কিংবা পারিবারিকভাবে ধনী ছেলেদেরই খোঁজেন মেয়ের বাবারা। যুথি আসমা, কাজ করেন গণযোগাযোগ নিয়ে। তিনি বলেন, আমি চাইছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর বিবাহ করতে। কিন্তু পরিবারের চাপে বিবাহ করতে হয়েছে। তবে পছন্দের মানুষকে বিবাহ করার কারণে খুব একটা পেরেশানি হয়নি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রাক্তন ১০ ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ৬ জনের বিবাহ হয়েছে পছন্দের মানুষের সঙ্গে। ৪ জনের সম্পর্ক থাকলেও বিবাহটা আর করা হয়নি।
৬ জনের একজন মৌসুমী আক্তার। তিনি বলেন, “পারিবারিকভাবে বিবাহতে হয়তো ধনী ছেলে পেতাম। কিন্তু এখন আমার স্বামীকে পেয়েছি বন্ধু হিসেবে। এই তো ক’দিন আগে একটা পরী হলো। আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি।”
বর্তমান সময়ে প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে পারিবারিক বিবাহ। শারমিন স্বর্ণা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের বিবাহ হয়েছে বছরখানেক আগে। আমরা দু’জনই চাকরিজীবী তাই সংসার চালানো সহজ হয়েছে। ওর একার আয়ে বিবাহটা করাই হতো না হয়তো।”
চলছে নভেম্বর মাস। বাংলাদেশে সাধারণত শীতকাল কেন্দ্রিক বিবাহ হয় অধিক। রংপুরের সদরের কাজী মো. আলতাফ হোসেনের কাছে সম্প্রতি হওয়া ১০টি বিবাহর কাগজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ৬ জন বরের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স বা তার থেকে বেশি। তাদের বয়সের গড় ২৯ বছর ৯ মাস। এর মধ্যে অনার্স সম্পন্ন ও অধ্যয়নরত কইে পাঁচজন। যাদের বয়সের গড় ২৬ বছর ৬ মাস। সর্বোচ্চ বরের বয়স ৩৩ বছর ও সর্বনিম্ন ২৩ বছর। সর্বোচ্চ কনের বয়স ছিল ২৯ বছর ও সর্বনিম্ন ১৯ বছর।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাজী আল আমিনের কাছে কাগজ না মিললেও তিনি বলেন, এখন তো অধিকাংশ ছেলের বয়স ৩০ এর কাছাকাছি থাকে। মেয়েদের বয়স এরকমই।
অনলাইনে ম্যারেজ মিডিয়া চালান মাঈন খান ও সায়মা আফরিন দম্পতি। তাদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, এখন অধিকাংশ বিবাহই হয় নিজেদের মধ্যে ঠিক করে। আর একটা বিষয় হলো- প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিবাহর পিঁড়িতে বসতে চান ছেলেরা। যার কারণে বর্তমান সময়ে ছেলেদের অধিকাংশেরই বয়স ৩০ ঊর্ধ্ব হয়।
এক গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিতদের মধ্যে ১৯৮০ দশকে বিবাহর গড় বয়স ছিল ছেলেদের ২৫ ও নারীদের ২২। আর ২০১১ সালে এসে তা হয় ছেলেদের ২৯ ও মেয়েদের ২৭। বিবাহ পিছিয়ে করলেও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সন্তানকে মানুষ করা। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও থাকে শঙ্কা। এমনটাই মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শাহ আলম। তিনি বলেন, “আমাদের সময়ে কিন্তু ক্যারিয়ার নিয়ে আমরা ভাবতাম পরে। আগে আসতো বিবাহ। সঙ্গীকে নিয়েই লড়াইটা চালিয়ে যেতাম আমরা।”
বিবাহর সঠিক বয়স কতো? জানতে চাইলে রংপুর ইকরা জামে মসজিদের ঈমাম মাওলানা মোহাম্মদ ইবাদত আলী বলেন, “সমাজের অনাচার ঠেকাতে সঠিক বয়সেই বিবাহ করা উচিত সকলের। বলছি না যে বাল্যবিবাহ দিতে হবে। সঠিক বয়সে বিবাহ হলে জেনা থেকে মুক্ত থাকা যায়। আর সেইসঙ্গে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকেন অভিভাবকরা। আর স্বামী কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে বসবাসে আল্লাহ বরকত দেন তাদের। তিনি বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই বিবাহ করা উচিত।”
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ছেলেদের ২১ ও মেয়েদের ১৮ বছর হলেই বিবাহ দেয়া আইনসম্মত। বিবাহর সঠিক বয়স সম্বন্ধে জানতে মনোচিকিৎসক বেলাল আহমেদ বলেন, বিষয়টা এমন নয় যে, ১৮ হলেই মানসিক বিকাশ হবে। আবার অনেকের ২৫ বছর বয়সেও মানসিক বিকাশ হয় না। তবে আমি মনে করি ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই বিবাহ সেরে ৩০ বছরের মধ্যে সন্তান নিয়ে নেয়া উচিত।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাস ওলফিঙ্গার তার গবেষণায় বলেন, বিবাহটা ছেলেদের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে করা উচিত।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী চিকিৎসক ডা. সাব্বির রহমান বলেন, আমার মতে বাংলাদেশের আবহওয়া অনুযায়ী ছেলেদের ২৫ থেকে ২৮ ও মেয়েদের ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই বিবাহ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অনেক শিক্ষিত তরুণ নানা নেশায় আসক্ত। তাদের মধ্যে যৌন ক্ষমতা নিয়ে আত্মবিশ্বাস অনেকের ক্ষেত্রে কম। আবার অনেকে নানা বাজে অভ্যাসে হারিয়ে ফেলছেন যৌন শক্তি। এ থেকেও বিবাহ-ভীতি দেখা দেয়। এটা শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেশি। তিনি পরামর্শ দেন, সামান্য আয় থাকলেও সামঞ্জস্য রেখে বিবাহ করতে। আর যৌনশক্তি নিয়ে ভীতি থাকলে লজ্জা ভুলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে। আবার রাজধানীসহ অনেক শহরে দিনকে দিন বিবাহ ছাড়াই একসঙ্গে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। অনেকের রয়েছে বিবাহর পর স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলার ভয়। পাশাপাশি ভয়াবহ আকারে বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ। চলতি বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকাতেই দিনে ৩৮টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এ হিসাবে প্রতি ৩৮ মিনিটে একটি দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতি মাসে ৯৯টি বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, ৭৫ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছেন নারী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে চার হাজার ৫৬৫টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে এক হাজার ১৪১টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪২। এই হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে বেড়েছে ৯৯টি বিবাহবিচ্ছেদ। গত বছরও নারীদের তরফে ডিভোর্স বেশি দেয়া হয়েছে ৭০ শতাংশ।
২০২০ ডিভোর্স হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্রীর। বিবাহ হয়েছিল পারিবারিকভাবে। তার ঘরে একটা ৭ বছরের ছেলেও আছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিবাহ হয়েছিল এইচএসসি পাসের পরই। আমাদের পরিবার এতটাই কনজাস্টটেড যে বিবাহ না করে ঢাকাতে পড়তে আসতে দেবে না। বিবাহ করতে হয় পরিবারের পছন্দে ফুপাতো ভাইকে। কিন্তু সে আমাকে মানসিক নির্যাতন করতো। কয়েকবার শারীরিক নির্যাতনও করেছে। মুখ বুঝে সহ্য করেছি। কারণ ওই ছেলের জন্য। এরপর দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠলো সব। এরপর চাকরিও হলো। তাই বিচ্ছেদের দিকেই এগোলাম। কারণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ঘর করা যায় না।