অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মায়ের ভাষার দাবিতে বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমান্বিত এক দিন। বাঙালির আত্মগৌরবের স্মারক অমর একুশের প্রথম প্রহর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হচ্ছে মহান ভাষা শহীদদের। মধ্যরাতের পর মানুষের হৃদয় নিঙরানো ভালবাসার ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ মিনার। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। একই সময়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ হাউস অব লর্ডসের স্পিকার ব্যারোনেস ডি সুজা। এর ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সঙ্গে ছিলেন রাজ্য সরকারের দুই মন্ত্রী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ ও কয়েকজন সংস্কৃতকর্মী। পরে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, তিন বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। শহীদ বেদিতে ফুল দেয়ার পর সেখানে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কুশল বিনিময় করেন। এসময় তারা দাঁড়িয়ে কিছু সময় কথা বলেন। এদিকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে তিনি গবির্ত। তিনি বলেন, শহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হিসেবে আমি নিজে গর্ব বোধ করি। ভাষা শহীদদের প্রতি আমি স্যালুট জানাই। এরপর শহীদ মিনারে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের চেয়ারপারসন সাবের হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তা, অ্যাটর্নি জেনারেল, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ভাষা সৈনিকরা। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মিনার সবার জন্য খুলে দেয়া হয়। এরপরই ঢল নামে সাধারণ মানুষের। নানা শ্রেণী পেশার মানুষ ফুল হাতে সারি বেঁধে এগিয়ে যান শহীদ বেদির দিকে। শ্রদ্ধা নিবেদনকে ঘিরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা গতকাল থেকেই ছিল নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সঙ্গে সারা দেশের শহীদ মিনারগুলোতেও একুশের প্রথম প্রহর থেকে চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। সকালে খালি পায়ে প্রভাতফেরির মিছিলে সবার কণ্ঠে ছিল অমর সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি..।’ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২-এ জীবন দিয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউল্লাহসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজকে মুখে মুখে বাংলা ভাষা। বাংলায় রচিত হচ্ছে হাজারো গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস আর অজস্র কথামালা। আজকের দিনটি শুধু সেসব বীর ভাষাসৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য যারা ভাষার জন্য অকাতরে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের দিনটি কেবল বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের সব প্রান্তে পালিত হবে বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুভেজা অমর একুশে। বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এরপর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয়ে আসছে দিনটি। ৬৩ বছর আগের এই দিনে বাংলার সংগ্রামী ছেলেরা যে ত্যাগ ও গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, তারই পথ ধরে আমরা মুখোমুখি হই স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাভ করি লাল সবুজের পতাকা। মহান ভাষা দিবস উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। এদিকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে দেশজুড়ে নানা কর্মসূচি পালিত হবে। ১৯৫২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে হরতালের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় একটানা এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র হরতাল, সভা, মিছিলের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনা করা হয়, চারজন চারজন করে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার। ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলতে থাকে। বিকাল ৩টায় গণপরিষদের অধিবেশনের আগেই শুরু হয়ে যায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। বিকাল ৪টায় পুলিশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। বুলেট কেড়ে নেয় জব্বার ও রফিকের প্রাণ। গুলিবিদ্ধ আবুল বরকত রাত পৌনে আটটায় হাসপাতালে মারা যান। তাদের মৃত্যু সংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শহীদদের স্মরণে সারা দেশে তৈরি হয় অসংখ্য শহীদ মিনার। নিñিদ্র নিরাপত্তা: শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গতকাল বিকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। মিনারমুখী সব রাস্তায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সতর্ক পাহারা। তাদের সঙ্গে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের কয়েক হাজার সদস্য। সন্ধ্যার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার ছাড়া কোন গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অমর একুশে উদযাপনের জন্য শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পুরো রাজধানীতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার থাকবে। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করা হবে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে রোববার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন। বিএনপি’র কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বিকালে দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ডাকা শহীদদের স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।