ঢাকা:সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে ৫৬৯ জন প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ১০০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী। বাকিরা সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।
এ দফায় ১ হাজার ৪টি ইউপিতে ভোট হচ্ছে। ২৮ নভেম্বর ভোট গ্রহণ করা হবে। গত বৃহস্পতিবার ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। এদিনই স্পষ্ট হয়ে যায়, অনেকের চেয়ারম্যান ও সদস্য হতে ভোট লাগছে না।
তৃতীয় ধাপের ভোটের আরেকটি দিক হলো, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কমেনি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১ হাজার ৬৯ জন নেতা অথবা কর্মী। দ্বিতীয় ধাপে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন প্রায় ৮৯৭ জন।
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাঁদের পক্ষে কাজ করা নেতা–কর্মীদের দল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। দলীয় নেতারা বিভিন্ন সময় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। বিদ্রোহীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তৃতীয় ধাপের ভোটেও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রচার শুরু থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত ২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা
নির্বাচন কমিশন থেকে কত প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হতে যাচ্ছেন, তার একটি হিসাব গতকাল শুক্রবার পাওয়া যায়। এই হিসাব অনুযায়ী, চেয়ারম্যান হিসেবে ১০০ জন, সংরক্ষিত নারী সদস্য হিসেবে ১৩২ জন ও সাধারণ সদস্য হিসেবে ৩৩৭ জন বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার পথে রয়েছেন। এর আগে প্রথম ধাপে ৪৩টি ইউপিতে (১৬০টির মধ্যে) চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউপির মধ্যে ৭৬টির চেয়ারম্যান পদে বিনা ভোটে প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এবার বিনা ভোটে যে ১০০ জন প্রার্থী জয়ী হতে যাচ্ছেন, তাঁদের ৯৯ জনই আওয়ামী লীগের। বাকি যে একজন বিনা ভোটে জয়ী হতে চলেছেন তিনি দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী। এই প্রার্থী হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুরের ছলিমাবাদ ইউনিয়নের মো. জালাল মিয়া। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। চাপের মুখে এই ইউপিতে নৌকার প্রার্থী আবদুল মতিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি খুব অসুস্থ। আমার পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’
যেসব জেলা–উপজেলায় বেশিসংখ্যক ইউপিতে ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না, তার একটি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। এই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের সব কটিতে চেয়ারম্যান ও সদস্যরা বিনা ভোটে জয়ী হচ্ছেন। জয়ী হতে যাওয়া এই প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং সরকারদলীয় সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর অনুসারী বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে রাউজানে এ বছর পৌরসভা নির্বাচন ও ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদেও ভোটের প্রয়োজন হয়নি।
রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবদুল ওহাব বলেন, এখানে কাউকে বাধা দেওয়া কিংবা হস্তক্ষেপ করা হয়নি। অবশ্য রাউজানের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, স্থানীয় পর্যায়ে দলের শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সাহস কারও নেই বলেই নির্বাচনে কেউ প্রার্থী হননি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে ১১টি ইউপির মধ্যে ৮টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটের দরকার হচ্ছে না। ৫টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া আর কেউ মনোনয়নপত্র জমাই দেননি। দুটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া বাকিরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। একটিতে ‘বিদ্রোহী’ বাদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ বাকিরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত চারজন প্রার্থী বলেন, স্থানীয় সাংসদের নির্দেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে চাপ দিয়েছেন। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনের সাংসদ এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, বলপ্রয়োগের কোনো ক্ষেত্র এখানে সৃষ্টিই হয়নি।
বড় নেতার স্বজনেরা বিনা ভোটে
চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট ছাড়াই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, মতলব উত্তরের মোহনপুর ইউনিয়নে বিনা ভোটে নির্বাচিত শামসুল হক চৌধুরী সাবেক ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর (মায়া চৌধুরী) ছোট ভাই। ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নে বিনা ভোটে নির্বাচিত নূর মোহাম্মদ চাঁদপুর-২ আসনের সাংসদ মো. নুরুল আমিন রুহুলের ছোট ভাই। ইলামাবাদ ইউনিয়নে নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন সরকার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের ভাতিজা। দুর্গাপুর ইউনিয়নে বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে যাওয়া চেয়ারম্যান প্রার্থী মোকাররম হোসেন খান কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের ছোট ভাই।
মতলব উত্তরের মোহনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা কাজী মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। রাজনৈতিক চাপ ও হুমকিতে তিনি প্রার্থী হননি।
এদিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টিতে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এসব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পাশাপাশি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, ইসলামী আন্দোলনসহ স্বতন্ত্রভাবে অনেকেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। সবাই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন।
বিদ্রোহী বেশি যেসব এলাকায়
তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে যেসব এলাকায় বিদ্রোহী বেশি, তার মধ্যে রয়েছে নরসিংদী, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মাগুরা।
নরসিংদীর দুটি উপজেলার ২২টি ইউপিতে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১ জনে। জেলার রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আসাদুল্লাহ ভূঁইয়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি বলেন, গত নির্বাচনেও তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে জয়ী হন। এবারও তিনি দল থেকে মনোনয়ন চেয়ে পাননি। কিন্তু এলাকার মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
মাঠে বিএনপির নেতারা
বিএনপি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তবে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের অনেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হয়েছেন। তৃতীয় ধাপের ইউপি ভোটে অংশ নিচ্ছেন দলটির প্রায় ৩৭৯ জন নেতা–কর্মী। এর মধ্যে বগুড়ায় সর্বোচ্চ ৩৩ জন, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে ১৫ জন করে, লালমনিরহাটে ১৭ জন, কুড়িগ্রামে ২০ জন, নওগাঁয় ২৮ জন, কুষ্টিয়ায় ১৫ জন, যশোরে ১৯ জন, সিলেটে ২১ জন ও মৌলভীবাজারে ১৯ জন রয়েছেন।
বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাংসদ জি এম সিরাজ বলেন, বিএনপির কোনো নেতা নির্বাচনে প্রার্থী হলে দলীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।