ঢাকা: স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তলমান তপসিলে এই পর্যন্ত ৩৯ জনের প্রাণ গেলো। এর মধ্যে ভোটের আগেই ১৬জন। এর মধ্যে একজন প্রিজাইডিং অফিসার কেন্দ্রের মধ্যেই স্ট্রোক করে মারা যান। সর্বশেষ মৃত্যু গতকাল রাত ১২টার দিকে ভোট কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরার পথে গুলিতে মারা যান রাজাবাড়ি জেলার এক আওয়ামীলীগ নেতা।
বৃহস্পতিবার ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের৷ এর মধ্যে নরসিংদীতে তিনজন, কুমিল্লায় দুইজন, কক্সবাজার চট্টগ্রাম ও রাজবাড়িতে ১জন করেেএবং কুষ্টিয়ায় এক প্রিজাইডিং অফিসার মারা গেছেন৷ এর আগে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটে মারা যান ছয়জন৷ এরপর থেকে ভোটের মাঠের প্রচারণায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে আরও ২৪ জনের৷ সবমিলিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে৷
হতকালের নির্বাচন:
গোলাগুলি, হামলা-সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, জালভোট, প্রকাশ্যে সিল মারাসহ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। আধিপত্য বিস্তার ও কেন্দ্র দখলের লড়াইয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন ৭ জন। এরমধ্যে নরসিংদীর রায়পুরায় গুলিতে মারা গেছেন তিনজন। কুমিল্লার মেঘনায় এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে একজন করে নিহত হয়েছেন।
রায়পুরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ৩, আহত ৩০
নরসিংদী ও রায়পুরা প্রতিনিধি জানান, রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ি ইউনিয়নে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩ জন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। গতকাল ভোরে বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের বটতলিকান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, বালুয়াকান্দি এলাকার হেকিম মিয়ার ছেলে মো. সালাউদ্দিন (৩০), সোবহানপুর এলাকার আব্দুল হকের ছেলে জাহাঙ্গীর (২৬) ও বটতলিকান্দি সিরাজ মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া (৩০)। সালাউদ্দিন, জাহাঙ্গীর স্বতন্ত্র প্রার্থী রাতুল হোসেন জাকিরের সমর্থক ও দুলাল নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আশরাফুল ইসলামের সমর্থক।
নিহতের স্বজনরা জানান, বাঁশগাড়ি ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আশরাফুল হক সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রাতুল হোসেন জাকিরের বিরুদ্ধে। তাদের সমর্থকদের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। গত বুধবার সন্ধ্যায় দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সারারাত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। ভোররাতে গুলি বিনিময়ে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।
মেঘনায় নিহত ২, বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে আহত অর্ধশত
স্টাফ রিপোর্টার, কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লার মেঘনা ও তিতাস উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপসহ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতায় মেঘনা উপজেলায় শাওন আহমেদ (৩০) ও সানাউল্লাহ ডালি (৬০) নামে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত শাওন মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়নের ভল্লবেরকান্দি গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে এবং সানাউল্লাহ ডালি ভাওরখোলা ইউনিয়নের খিরারচর গ্রামের মৃত মোজাফফর হোসেনের ছেলে। এ ছাড়া দুই উপজেলায় কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মেঘনা উপজেলার আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে আধিপত্য নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নৌকা ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি চালায়। এ সময় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক শাওন আহমেদ, জয় মিয়া, শামীম, মকবুল হোসেন, আলামিনসহ ১৫ জন আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শাওনকে মেঘনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এতে প্রায় এক ঘণ্টা কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। খবর পেয়ে জেলাপ্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে পুনরায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। নিহত শাওনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন মেঘনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. বর্ষা লরেন।
এদিকে ওই ইউনিয়নের বারহাজারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত মুকবেল, আলাউদ্দিন, আল-আমিন ও সোহরাবকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
এর আগে ওই ইউনিয়নের মানিকারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলের অভিযোগে স্থানীয় একটি মসজিদের মাইকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হারুন অর রশীদের পক্ষে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়। এ ঘটনায় মাওলানা নাজমুল নামে একজনকে আটক করে পুলিশ।
এদিকে একই উপজেলার ভাওরখোলা ইউনিয়নের খিরারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে সানাউল্লাহ ডালিসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় সানাউল্লাহ ডালিকে উদ্ধার করে ঢাকা নেয়ার পথে তিনি মারা যান বলে পুলিশ জানিয়েছে।
কক্সবাজারে নিহত ১, আহত ৩৩, স্থগিত কেন্দ্র ২
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার থেকে জানান, কক্সবাজারে বিশৃঙ্খলা এবং সহিংসতার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে জেলার ৩ উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ। সহিংসতায় সদরের খুরুশকুলের তেতৈয়ায় একজন নিহত ও দুই পুলিশসহ ৬ জন আহত হয়েছে। এতে ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে। উখিয়ার হলদিয়া পালংয়ে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সংঘর্ষে উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরসহ ১২ জন আহত হয়েছে এবং ১টি ওয়ার্ডের ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে।
উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউপির স্থগিত ৫ নম্বর কেন্দ্রে ১৫ জন আহত হয়েছেন। তাদের মাঝে মেম্বার প্রার্থী বাদশাসহ ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। উখিয়ার জালিয়াপালং এক কেন্দ্রে নৌকার পক্ষে জোর করে সিল মারার অভিযোগ করেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী।
সদর উপজেলার ঝিলংজা, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী ও ভারুয়াখালি এবং পিএমখালীর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে খুরুশকুলে তেতৈয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালযে ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী শেখ কামাল ও আবু ছিদ্দিকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আকতারুজ্জামান পুতু (৩০) নামের একজন নিহত হয়। এ ছাড়া দুই পুলিশসহ ৬ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া চৌফলদন্ডীর ইউপির ৩, ৭, ও ৮ নং ওয়ার্ডে এক মহিলা সদস্যের এজেন্ট এবং পুলিশের এক এএসআই আহত হয়েছে।
উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ শাহ আলম ও বিদ্রোহী প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের ইমরুল কায়েস চৌধুরীর সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া জালিয়াপালংয়ে বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল আমিন গতকাল দুপুর ২টার দিকে ইউনিয়নের ৯টি কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, নৌকা প্রতীকের এজেন্টরা ভোটারদের সিল মারতে না দিয়ে ব্যালট কেড়ে নেয় এবং প্রত্যেকটা বইতে নিজেরাই সিল মেরে দিচ্ছে। আমি এ বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে মৌখিক অভিযোগ করেছি। আমাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেছে বিষয়টি তিনি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে। এক প্রশ্নের জবাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল আমিন বলেন, আমি ৯টি কেন্দ্রই পরিদর্শন করেছি। শুধু ৩নং ওয়ার্ডের সোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেই নৌকার পক্ষে জোর করে সিল মারা হয়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা ও গণ্ডগোলের কারণে ২০ জনকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, তেতৈয়া দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে।
ফটিকছড়িতে নিহত ১
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, কেন্দ্র দখল, সড়ক অবরোধ, গোলাগুলিসহ বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। দ্বিতীয় দফার এই নির্বাচনে এই তিন উপজেলার ৩৯ টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বুধবার ভোটের রাত থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ শেষ পর্যন্ত তিন উপজেলায় সংঘর্ষে ১ জন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন।
জানা যায়, ভোটের দিন দুপুরে ফটিকছড়ির লেলাংয়ের গোপালঘাটায় একটি ভোটকেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে মোহাম্মদ শফি (৪৮) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আরও ৮ জন আহত হয়েছেন। একই উপজেলায় বাগানবাজারে বুধবার মধ্যরাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকার প্রার্থী রুস্তম আলীর সমর্থকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্রোহী প্রার্থী সাজুর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এতে ৬-৭ জন আহত হন। আহতদের ৩ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া উপজেলার পাইন্দংয়ে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।