‘চোখ বেঁধে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ’

Slider জাতীয়

64566_b4

পুলিশের গুলিতে স্বপ্ন খুইয়েছেন মাসুদ। কি কারণে পুলিশ তাকে ধরে পায়ে গুলি করেছে সে জানে না। শুধু জানে বিনা কারণে শাস্তি ভোগ করছে সে। তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার এখন। মাসুদ জানায়, ‘ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আমাকে শারীরিক নির্যাতন করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আমি যাচ্ছিলাম প্রাইভেট পড়তে। এ কথা বলার পরও আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডি থানায়। সেখানে লাল গামছা দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে দু’জন পুলিশ সদস্য। আবারও চলে নির্যাতন। এ অবস্থায় কয়েকজন পুলিশ আমাকে নিয়ে যায় থানার পিছনে। সেখানে খোলা জায়গায় আমার ডান পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। আমি কখনও রাজনীতি করিনি। ঢাকায় পড়তে এসেছি। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের সেবা করবো। কিন্তু পুলিশ আমার পায়ে গুলি করে আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিলো।

জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি  ভাসকুলার বিভাগের ৮ নম্বর বিছানায় শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন ক্যামব্রিয়ান কলেজের লালমাটিয়া শাখার এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী কাওসার আলম মাসুদ (১৭)। তবে মাসুদের পায়ে গুলি করার বিষয়ে পাওয়া গেছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। তার পরিবারের অভিযোগ মেধাবী মাসুদকে পড়ালেখা করতে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রাজনীতির জন্য নয়। সে কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িতও নয়। কোন কারণ ছাড়াই তাকে জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করার অভিযোগে তার পায়ে গুলি করা হয়েছে। তবে পুলিশের অভিযোগ, গুলিবিদ্ধ মাসুদ জামায়াত-শিবিরের একজন কর্মী। ঘটনার দিন সে ও তার কয়েকজন সঙ্গী ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোড এলাকায় মিছিল বের করে। পুলিশ বাধা দিলে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে, পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি করলে মাসুদ আহত হয়। গ্রেপ্তারের পর তার ব্যাগে পেট্রল পাওয়া যায় বলেও পুলিশ দাবি করেছে। ধানমন্ডি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসুদ ও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে। গতকাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশি প্রহরায় মাসুদের চিকিৎসা চলছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মাসুদ। মুখে, পিঠে, অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন। ডান পায়ে উরুর নিচে ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজের গজ উপচে রক্ত বেরুচ্ছে। একটু পর পর ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছেন তিনি। মাসুদ জানান, ওই দিন বিকালে ঝিগাতলা গাবতলার বাসা থেকে খালাতো ভাই তুষারের কাছে পড়ার জন্য আজিমপুর খালার বাসায় যাচ্ছিলেন তিনি। পথিমধ্যে ধানমন্ডি সিটি কলেজের সামনে একটি মিছিল থেকে হঠাৎ ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। ভয়ে দৌড়ে সিটি কলেজের সামনের রাস্তা পার হয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে চলে যান তিনি। সেখানে স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে ‘বোমাবাজ’ আখ্যা দিয়ে বেদম মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর পুলিশ তাদের হেফাজতে তাকে নিয়ে যায় ধানমন্ডি থানায়। সেখানে লাল গামছা দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলে পুলিশ। চলে চরম শারীরিক নির্যাতন। চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায় থানার পিছনে। সেখানে ডান পায়ের হাঁটুর নিচে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে এক  পুলিশ। গল গল করে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বের হতে থাকে। এ অবস্থায় ধানমন্ডি থানার কয়েকজন পুলিশ তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তার রক্তক্ষরণ বন্ধ করা হয়। এরপর চিকিৎসকরা তাকে পাঠিয়ে দেন শেরেবাংলানগর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ভাসকুলার সার্জারি বিভাগে। বুধবার রাতে তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে আবারও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মাসুদ জানান, তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার মাইঝদি থানার নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। মো. আবুল হোসেন ও কুলসুমা ইয়াসমিনের ৪ ছেলে মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনি। ২০১৪ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন রাজধানীর ক্যামব্রিয়ান কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে। তার ইচ্ছা ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন এখন ধূলিসাৎ হওয়ার পথে। কান্না ভেজা চোখে মাসুদ বলেন, আমার পায়ে গুলির ক্ষত কোনদিনই মুছবে না। আমার স্বপ্ন বোধ হয় আর পূরণ হবে না। যন্ত্রণায় কাতর মাসুদ জানান, আমি কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। সকাল ৮টায় কলেজে যাই। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ক্লাস শেষে বাসায় ফিরি। সন্ধ্যায় পড়তে বসি। পুলিশ বলছে আমার ব্যাগে নাকি পেট্রলবোমা পাওয়া গেছে। আমি কোনদিন ককটেল, পেট্রলবোমা চোখেও দেখিনি। মাসুদের পিতা আবুল হোসেন বলেন, ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তাকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছিলাম। সে কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু কেন পুলিশ তাকে এভাবে গুলি করলো তা বুঝতে পারছি না। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। মাসুদের রুমমেট খলিলুর রহমান সুজন। তিনি বলেন, মাসুদকে অনেকদিন ধরেই চিনি। খুবই ভদ্র ছেলে। সে কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। সকালে কলেজে যায়। বিকালে ফিরে আসে। সন্ধ্যায় পড়তে বসে। এই তার রুটিন। কিন্তু কেন পুলিশ তাকে গুলি করলো তা বুঝতে পারছি না। ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, মাসুদসহ আরও কয়েকজন ওই দিন মিছিল বের করে। তারা মিছিল থেকে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে শটগানের গুলি ছুড়লে সে আহত হয়। মাসুদকে থানায় নিয়ে পায়ে গুলি করার বিষয়টি মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, ও মিথ্যা বলছে। ওর ব্যাগে পেট্রল পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনের নামে মামলাও হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল ইসলাম বলেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত যা পেয়েছি তাতে জানতে পেরেছি, মাসুদসহ কয়েকজন ওই দিন (বুধবার) ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোড এলাকায় মিছিল বের করে। পুলিশ বাধা দিলে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে মাসুদ গুলিবিদ্ধ হয়। মাসুদকে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে নির্যাতন ও থানার পিছনে গুলি করার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ধরা পড়লে সবাই এরকমই বলে। তার ব্যাগে পেট্রল পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। মাসুদ একটু সুস্থ হলে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *