ঢাকা:এমনিতেই নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনজীবনে মারাত্মক চাপ পড়বে বলে মনে করছেন দেশের জ্বালানি ও বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ১২ থেকে ১৩শ’ কোটি টাকা রয়েছে বিপিসি’র কাছে। ওই টাকা থেকে সরকার খরচ করতে পারতো। তা না করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তেলের দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে গতকাল ৪ঠা নভেম্বর থেকেই কার্যকর হয় বাড়তি ডিজেল ও কেরোসিনের নতুন দাম। এক লাফে লিটার প্রতি বেড়েছে ১৫ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে করে পরিবহন ও কৃষি ব্যয় বাড়বে।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই জ্বালানি তেলের এই দামের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কেমিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সরকার গত এক বছরে তেল বিক্রি করে অনেক লাভ করেছে। সেই টাকা গেল কোথায়? যেই টাকা লাভ করেছে সেই টাকা ভর্তুকি দিতে পারতো। সরকারকে বিষয়টি স্বচ্ছভাবে করা দরকার ছিল। তেলের দাম বিশ্ববাজারে বাড়লে ৬ মাস পরে তেলের দাম সরকার বাড়াতে পারে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে সম্প্রতি। অল্প ক’দিন হলো। হঠাৎ করে এত বেশি টাকা বাড়ানো উচিত হয়নি। সরকার তেলের দাম কম থাকা অবস্থায় ৩ টাকা কমিয়ে প্রহসন করেছে উল্লেখ করে ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সুষ্ঠু ফর্মুলা হলো তেলের দাম বাড়লে দাম বাড়বে আর কমলে কমবে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা নেই। তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে মানুষের মধ্যে বিরাট শক তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে পরিবহন খাতে। তারা তো রাতারাতি পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। এই দাম বৃদ্ধি যদি ধাপে ধাপে করতো, তাতে হয়তো সবাই কিছুটা মানিয়ে নেয়ার সুযোগ পেতো। এত বেশি বাড়ানো দেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পরিবহন ব্যয় বাড়ায় আমাদের নিত্যদিনের ব্যয় যেমন বাড়বে পাশাপাশি এই অজুহাতে বেড়ে যেতে পারে বিদ্যুতের দামও। কারণ আমাদের এখনো অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিজেলচালিত। একইসঙ্গে সেচকাজে ডিজেলের ব্যবহার হওয়ায় কৃষিতেও এর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে যে দাম বাড়ালেন, কমলে সেই দাম কমাতেও হবে। আমাদের এখানে সাধারণত বাড়ানোর পর দাম ওই রকমই রেখে দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ডিজেলের সঙ্গে সঙ্গে কেরোসিনের দাম বাড়ানোর ফলে কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে আসবে আরও কঠিন পরিস্থিতি। সরকারের এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত ছিল।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ১ হাজার কোটি টাকার ফান্ড রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিপিসি’র কাছে আছে। এটা ৩ বছর আগের হিসাব। এখন তা বেড়ে ১২ থেকে ১৩শ’ কোটি টাকা হয়েছে। এই মুহূর্তে ওই টাকা থেকে সরকার খরচ করতে পারতো। বাজারে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম বেশি। এমন অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনজীবনে মারাত্মক চাপ পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম মানবজমিনকে বলেন, দুই বছর বা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে তেল বিক্রি করে সরকার লাভ করেছে। সেই টাকা কোথায় গেল? যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ছিল তখন দেশে বেশি দামে তেল বিক্রি করেছে।
তিনি বলেন, করোনাকালে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। এমনিতেই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় তেলের দাম বাড়ার ফলে ভয়ঙ্কর অবস্থার আশঙ্কা করছেন এই বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার পর হঠাৎ করে ১৫ টাকা লিটারে বাড়ানো যুক্তিযুক্ত কিনা জানতে চাইলে ক্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এভাবে এত দাম বাড়ানো মোটেও যৌক্তিক হয়নি। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে তিন মাস সময় লেগে যায়। প্রতিদিনের তেল তো আর বিপিসি প্রতিদিন কিনে আনে না। একইভাবে এলপিজি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়েও দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে তখন তারা কিন্তু সহজে দাম কমান না। লোকসান পোষানোর কথা বলতে থাকেন। এটা এক ধরনের লুণ্ঠনমূলক আচরণ। এখন তো তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ব্যয়, পণ্যের ব্যয় সব বাড়বে এবং এই বৃদ্ধি সমস্ত উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করবে। পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধিসহ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার জনগণের স্বার্থ একেবারেই দেখলো না।
বিপিসি সূত্র বলছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। দেশে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছিল ৬৫ টাকায়। তাতে লিটার প্রতি ১৩ থেকে ১৪ টাকা লোকসান হচ্ছিল। প্রতিদিন ডিজেল ও ফার্নেস তেল বিপণনে ২০ কোটি টাকার মতো লোকসান হচ্ছিল। বিপিসি’র তথ্য অনুযায়ী, চাহিদা পূরণে প্রতিবছর ৪০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। আর অকটেন আমদানি করা হয় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন। প্রায় সমান পরিমাণ পেট্রোল উৎপাদন করা হয় দেশীয় উৎস থেকে। আগে পেট্রোল ও অকটেন বিপণনে বিপিসি’র মুনাফা থাকলেও এখন তার বদলে লোকসান হচ্ছে বলে কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়, তার ৭৩ শতাংশের বেশি ডিজেল। সড়ক ও নৌ-পরিবহন, কৃষির সেচ পাম্প এবং বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা ক্ষেত্রে ডিজেলের ব্যবহার রয়েছে। বিপিসি’র হিসাবে, ২০১৯-২০২০ বছরে বিপিসি ৫৫ লাখ ৩ হাজার টন জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে। এরমধ্যে ডিজেলের পরিমাণ ৪০ লাখ ২৩ হাজার টন।