কুমিল্লাসহ সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি-মন্দির-পূজাম-পে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এবং পরে আওয়ামী লীগের একটি আলোচনাসভায় বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তার মনোভাব জানান।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কুমিল্লায় পূজাম-পে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি বলেছেন, স্টার্ন অ্যাকশনে যেতে হবে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের অবশ্যই ধরতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে একটুু ধৈর্য ধরতে হবে, রি-অ্যাকশন করা যাবে না। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, আজকে (সভায়) এটিই বলা হয়েছে, অলরেডি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়েছে- স্টার্ন অ্যাকশন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যারা এগুলোর সূত্রপাত করল তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবে। পাশাপাশি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বলা হয়েছে, ছোটখাটো টুয়িস্টিং কেউ করলেই যে এভাবে রি-অ্যাকশন করতে হবে, এটা করা যাবে না।
এদিনই বিকালে আওয়ামী লীগের আলোচনাসভায় দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এ দেশে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করবে। আমাদের সংবিধানেও তা বলা আছে। ইসলামেও সে কথাই বলা হয়েছে। মহানবী (স) বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। সুতরাং আমরা চাই ধর্ম নিয়ে যেন কেউ বাড়াবাড়ি না করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের প্রধান কার্যালয়ে এ আলোচনাসভা হয়।
ঘরবাড়ি ভাঙার অথরিটি কোরআন দেয়নি
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যোগ দেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে মাঠ প্রশাসন (জেলা-উপজেলা) কাজ করে, এখানে কোনো ঘাটতি আছে কিনা এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল বলেন, আমার কোরআনের যদি কেউ অবমাননা করে, কোরআন আমাকে অথরিটি দেয়নি যে ঘরবাড়ি ভাঙব। এটা অপরাধ। ধর্ম নিয়ে অবমাননা করে তা হলে প্রতিবাদ করতে পারি, সরকারের কাছে দাবি করতে পারি যে ধরে শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু ধ্বংসাত্মক কাজ করব, এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য, এটি ঠিক নয়। ইসলামে যেটা সবচেয়ে বড় অপরাধ ফিতনা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ বিষয়ে (কুমিল্লার বিষয়ে) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়মিত ব্রিফ করছেন, সেখানে আমাদের ইন্টেলিজেন্সও কাজ করছে। গতকাল রাতেও আমরা বসেছিলাম। নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজকে ব্রিফ করবেন। সে জন্য আমি আর এটা নিয়ে বলছি না। কুমিল্লার বিষয়ে আমার ধারণা যে খুব কুইকলি একটা ফাইন্ড আউট হবে।
মানবতার প্রশ্ন যারা তোলে তারা যেন দেখে
শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নেন। জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের পাশাপাশি গৃহহীনদের ঘর করে দেওয়া তার সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে এসময় তিনি বলেন, এই দেশে একটি শিশুর মেধা ও জ্ঞান যাতে যথাযথভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং সে বাংলাদেশকে যেন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এত রক্তক্ষয় এত কিছু বাংলাদেশে ঘটে গেছে। কাজেই এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে।
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলোচনাসভায় প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন। আরও বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক ছিদ্দিকুর রহমান, দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি তার বাবার আদর্শ নিয়েই এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং এ দেশে আর শিশুরা যাতে কোনোরকম নির্মমতার শিকার না হয়। তিনি বলেন, এখনো মাঝে মাঝে সেই নির্মমতা আমরা দেখি। এটা যেন আর না হয়। কারণ দেখেছি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে কিভাবে মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে, শিশুদের পর্যন্ত। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বিরোধী দলে থাকার সময় তার অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়েছে মানুষজন। বাবা দেখেছে তার চোখের সামনে কিভাবে সন্তান আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। সে রকম নিষ্ঠুর ঘটনা তো দেশে ঘটেছে। রাসেলের মতো আর কোনো শিশুকে যেন হত্যার শিকার হতে না হয়, সে জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে মানবতার প্রশ্ন যারা তোলে তারা যেন এই ঘটনাগুলো ভালোভাবে দেখে যে, বাংলাদেশে কী ঘটত। কিন্তু আমরা সরকারে আসার পর আমাদের প্রচেষ্টা- কোনো শিশু রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না, টোকাই থাকবে না। তাদের যেন একটা ঠিকানা থাকে তারা যেন একটু ভালোভাবে বসবাস করতে পারে।
জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পাননি ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেলও। বঙ্গবন্ধুর সাথে নরপিশাচরা নির্মমভাবে তাকেও হত্যা করে। তিনি তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।