কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হামলা, সংঘর্ষের মামলায় গতকাল পর্যন্ত ৫৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭২টি। আসামি করা হয়েছে ৭ হাজার ৭শ’ ৭৫ জনকে। এসব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। সেইসঙ্গে সক্রিয় রয়েছে র্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও। প্রায় প্রতিদিনই ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শন করছেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে কুমিল্লার ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ বিষয়ে গতকাল ‘র?্যাবের প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন’ শীর্ষক কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, কুমিল্লার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত চিহ্নিত হয়েছে, তাকে শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে।
সে বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। অল্প সময়ের মধ্যে তাকে আমরা ধরে ফেলতে পারবো। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই কুমিল্লায় কেন সে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা জানা যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এবার অপ্রীতিকর কিছু ঘটনা ঘটেছে। কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরে কিছু উগ্র মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উপাসনালয়ে ভাঙচুরের চেষ্টা করেছে। সেখানে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সেখানে চারজন নিহত হয়েছেন। গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, কেন এই হত্যাকাণ্ড, কেন এই মৃত্যু, কার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার জন্য এই মৃত্যু? আমরা দেখলাম পরিতোষ নামে এক অল্প বয়সী ছেলে ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়েছে। এটাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা। আমাদের পুলিশ বাহিনী তার বাড়িঘর রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। সেই পরিতোষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে তার পাশের গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর হয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। তিনি বলেন, অতীতেও ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে রামু, নাসিরনগর ও ভোলায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও একটি মামলা হয়েছে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, দাউদকান্দি ও নগরীতে প্রতীমা ভাঙচুর, হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত তিনটি থানায় মোট আটটি মামলা হয়েছে। এই আট মামলায় এজাহার নামীয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের জামায়াত সমর্থিত তিন কাউন্সিলরসহ অজ্ঞাত অন্তত ৮শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ছয়টি মামলায় বাদী হয়েছে পুলিশ।
এদিকে নগরীর কোতোয়ালি থানায় র্যাবের ডিএডি এবং দাউদকান্দি থানার মামলায় গৌরাঙ্গ ভৌমিক নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়েছেন। এখন পর্যন্ত আট মামলায় পুলিশ ও র্যাব ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে। মামলায় কুমিল্লা নগরীর এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী গোলাম কিবরিয়া, ছয় নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন ও আট নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইকরাম হোসেন বাবুকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দীঘির উত্তরপাড়ে গত বুধবার সকালে একটি পূজামণ্ডপের ঘটনার পর জেলার বিভিন্নস্থানে হামলা, ভাঙচুরসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব বাদী হয়ে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় পৃথক পাঁচটি মামলা করেছে। এই মামলায় ৬২ জনকে এজাহারনামীয় ও ৫শ’ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এছাড়া জেলার সদর দক্ষিণ মডেল থানায় দুটি মামলায় ৩০ জনকে এজাহারনামীয় ও ১৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা এবং দাউদকান্দি মডেল থানার একটি মামলায় ৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
এসব মামলার মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ ৩৯ জনকে ও সদর দক্ষিণ মডেল থানা পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এম তানভীর আহমেদ বলেন, পূজামণ্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় কুমিল্লা কোতোয়ালি, সদর দক্ষিণ ও দাউদকান্দি থানায় পৃথকভাবে আটটি মামলা হয়েছে। এই আট মামলায় এখন পর্যন্ত কোতোয়ালীতে ৪০ এবং সদর দক্ষিণে চারজনসহ মোট ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি জানান: পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গতকাল বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, নাশকতামূলক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করার মতো সাহস তারা কোথা থেকে পায়, এটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যারা নাশকতা চালিয়েছে তাদের অনেকেই স্থানীয় লোক নয়। তারা বহিরাগত। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত হয়ে মাঝিপাড়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে ২৮টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার প্রশ্ন, আমাদের পীরগঞ্জ উপজেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা উজ্জ্বল উদাহরণ ছিল। এবারের দুর্গাপূজায় উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৯৮টি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদ্যাপিত হয়েছে। তারপরও কেন এই নাশকতার ঘটনা আমাদের দেখতে হলো, কারা এই বহিরাগত, কেন তারা এ ধরনের অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটালো?
প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ঘটনা পরিকল্পিত। এ পরিকল্পনার পেছনে কারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করছি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধী কারা এবং প্ল্যানিংয়ে কারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। ইতিমধ্যে ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে তরুণ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল সেই পরিতোষকেও গ্রেপ্তার করে কোর্টে হাজির করা হয়েছে। কাজেই যারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে কঠোরতম আইনের আওতায় এনে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের ঘটনা যেন পীরগঞ্জের মাটিতে আর কখনো না ঘটে- সে জন্য আমাদের প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, পৌর মেয়র এসএম তাজিমুল ইসলাম শামীম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রাণী রায়সহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা।