আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে অভিযোগের পাহাড়

Slider রাজনীতি


সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত, চার্জশিটভুক্ত আসামি, নারী নির্যাতনকারী ও অনুপ্রবেশকারীসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অভিযুক্তরাও দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। ত্যাগী ও স্বচ্ছ ইমেজের প্রার্থীদের গুরুত্ব না দিয়ে বিতর্কিতদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় তৃণমূলে চলছে ক্ষোভ; কেন্দ্রে একের পর এক অভিযোগ দিচ্ছেন মনোনয়নবঞ্চিতরা। বিতর্কিত প্রার্থী পরিবর্তন না হলে ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলেও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তারা। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভাষ্য, অনেক ভেবেচিন্তে, যাচাই-বাছাইয়ের পর দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অবশ্য অভিযোগ পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থী পরিবর্তনও করছে দলটি।

দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে টানা পাঁচ দিন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক হয়। এ সময় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মেহেরপুরের মুজিবনগরের মহাজনপুর ইউনিয়ন, খুলনার ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন এবং নড়াইল সদরের বিছালী ইউনিয়নের প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবার পরিবর্তন করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সদর ও হরিপুর ইউনিয়নের দুই প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান আমাদের সময়কে বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক চলাকালে বিতর্কিত প্রার্থীর নাম এলে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সত্যতা পেলে প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে। এখন যেসব অভিযোগ আসছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমি জানি না। তবে এখন তো দ্বিতীয় ধাপের জন্য মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক আর নেই।

জানা গেছে, ফতুল্লা থানা বিএনপির সহসভাপতি ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই বলেন, তিনি কীভাবে মনোনয়ন পেলেন, কারাই বা প্রস্তাব করল আমি কিছু জানি না। সেন্টু বিএনপি করেন কিনা জানতে চাইলে আবদুল হাই বলেন, সেন্টু শুধু বিএনপি নয়, ভূমিদস্যু ও কিলার।

অভিযোগ রয়েছে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের রসুলপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল হোসেন সেলিম নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপ, মদ খেয়ে মাতলামি, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে জুয়া খেলা অবস্থায় তাকে নোয়াখালী ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় তিনি প্রায় ১ মাস জেল খাটেন।

বেগমগঞ্জের নরোত্তমপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান হারুন উর রশিদ বাচ্চু গত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি নাশকতা ও গাড়ি পোড়ানোর মামলার আসামি। তার নেতৃত্বে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এত কিছুর পরও সম্প্রতি তাকে আহ্বায়ক করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি করা হয়। এ নিয়ে দলে কোন্দল দেখা দেয়। রাজগঞ্জ ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম আবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও যুবলীগ নেতার বাড়িতে হামলার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নারী নির্যাতন মামলার আসামি বলেও অভিযোগ রয়েছে। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনম সেলিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব তথ্য সঠিক নয়।

বিদেশে থেকেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শরীয়তপুরের মাহমুদপুর ইউনিয়নের শাহ আলম মুন্সী। দলে নিষ্ক্রিয় এ যুবলীগ নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ায় চলছে সমালোচনা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, তৃণমূল থেকে যে তালিকা পাঠিয়েছিলাম তাতে আলম মুন্সীর নামই ছিল না। আমার কাছে রহস্য- তিনি কীভাবে মনোনয়ন পেলেন।

কক্সবাজারের রামুর রশিদনগর ইউনিয়নে নৌকা পেয়েছেন মোয়াজ্জেম মোর্শেদ। তার বিরুদ্ধে শিবির নেতাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রণি বলেন, মোয়াজ্জেম মোর্শেদ চট্টগ্রামের এক আতঙ্কের নাম। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ও মহানগরে শিবিরের দুর্র্ধর্ষ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত।

চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহামুদুল করিম বলেন, আমি ২০১০ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই। সে সময় মোর্শেদ কলেজ শিবিরের অন্যতম নীতিনির্ধারক ও ক্যাডার ছিলেন। ছাত্রলীগ করায় সে ২০১১ সালের জুলাইয়ে হামলা করে আমার পা ভেঙে দেয়। এর পর ২০১৩ সালে ২৯ অক্টোবর আমি পরীক্ষা দিতে গেলে আমাকে হল থেকে তুলে নিয়ে যায় মোর্শেদ ও তার দলবল। সোহরাওয়ার্দী হলের তখনকার পরিত্যক্ত হিন্দু হোস্টলে নিয়ে আমার আঙুলের নখ তুলে আমাকে গুরুতর জখম করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রাখে।

এ বিষয়ে মোয়াজ্জেম মোর্শেদ বলেন, আমি ২০১০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বের হয়েছি। তাই এর পর কী হয়েছে সেখানে আমার জানা নেই। আমি মাহামুদুল করিম নামের কাউকে চিনি না। তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার কলেজে অনার্সে পড়ার সময় আমি ছাত্রলীগ করেছি। কক্সবাজার ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি আমার। রামু উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া বলেন, আমি দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মোর্শেদ নৌকা প্রতীক পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তার নামই শুনিনি।

জানা যায়, রশিদনগরের মঞ্জুর মোর্শেদের ছেলে মোয়াজ্জেম মোর্শেদ ২০১৭ সালে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদে ভর্তি হন। তবে সেখানে কখনো তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি করেনি। কিন্তু জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি আসার পর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোসাইনকে খালাত ভাই দাবি করে মোর্শেদ নিজেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত করার চেষ্টা করেন।

তবে সাদ্দাম হোসাইন বলেন, মোয়াজ্জেম মোর্শেদ আমার খালাত ভাই নয়। আমার পাশের ইউনিয়নের ছেলে। আমি সভাপতি হওয়ার পর তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আমার নামে বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার-ফেস্টুনও দেন। কিন্তু আমি খবর নিয়ে জানতে পারি তিনি অতীতে কখনো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ছিলেন না। বরং শিবিরের ক্যাডার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন বলে প্রমাণ পাই। পরবর্তী সময় আমি তার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। দলীয় প্রোগ্রামেও তার আসা নিষিদ্ধ করি।

শুধু এসব এলাকাতেই নয়, সারাদেশে অনেক জায়গায় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *