এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসায়ের নাম করে একযুগ ধরে ব্যবসা করেছে ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা সুকৌশলে জনগণের কাছ থেকে ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এর মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা পাচারও করেন তারা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক এবং পরে আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমল মিলিয়ে এক যুগ এভাবে চালানোর পর ডেসটিনি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে ২০১২ সালে। ৮ বছর কেটে গেলেও গ্রাহকদের কেউ কোনো টাকা ফেরত পাননি। ডেসটিনির নিজের হিসাবেই তাদের ক্রেতা, পরিবেশক ও বিনিয়োগকারী মিলে ৪৫ লাখ। ডেসটিনির আদলে পরবর্তী সময়ে যুবক, ইউনি পে টুসহ একের পর এক এমএলএম কোম্পানি গড়ে ওঠে। যাদের বেশির ভাগই গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে যায়।
তবুও থেমে থাকেনি এই পদ্ধতিতে প্রতারণা। এখন বদলেছে প্রতারণার ধরন। অনেক প্রতারণামূলক স্কিমে অর্থ বিনিয়োগ করে পুঁজি খুইয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। হালের আলোচিত ই-কমার্স ব্যবসা ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ হাতিয়ে নিয়েছে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তালিকায় আছে আরও গোটা দশেক। ডেসটিনির গ্রাহকদের মতো তাদেরও অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নীরবতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণামূলক স্কিমগুলো প্রকাশ্যেই বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরই এ নিয়ে টনক নড়ছে কর্তৃপক্ষের। এরই মধ্যে অনেক স্কিমের হোতারা আটক হলেও অর্থ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। জানা গেছে, ডেসটিনির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে, নিষ্পত্তি হয়নি একটিরও। আদালত ৪ বছর আগে ডেসটিনির কাছ থেকে টাকা ফেরত আনার একটি উপায় বের করলেও তা কাজে দেয়নি। ফলে একটি করে বছর যাচ্ছে, আর বাড়ছে গ্রাহকদের বঞ্চনা। মাঝখানে ডেসটিনির গাছ বিক্রি করে টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব পড়েছিল একজন সংসদ সদস্যের ওপর। কিন্তু সে উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আপিল বিভাগের শর্ত ছিল ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন এবং ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন জামিন পাবেন, যদি ৬ সপ্তাহের মধ্যে ৩৫ লাখ গাছ বিক্রি করে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা অথবা নগদ ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়। এ নির্দেশনা এখনো বহাল। কিন্তু এক টাকাও জমা হয়নি। আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সাল থেকেই ডেসটিনির নামে থাকা বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব পুলিশের। অর্থাৎ, ডেসটিনির সম্পদের রিসিভার বা তত্ত্বাবধায়ক পুলিশ। রাজধানীতে থাকা ডেসটিনির সম্পদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং রাজধানীর বাইরের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা কথিত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিজেদের নামেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন। এগুলোর মধ্যে বাড়ি, গাড়ি, সিনেমা হল ছাড়াও রয়েছে পাটকল, হিমাগার, টেলিভিশন চ্যানেল ও ধানি জমি। তবে ডেসটিনির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে ডিএমপির একটি কমিটি রয়েছে। ‘ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ২০০০ লি. নামক কোম্পানির ক্রোককৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি সংক্রান্ত আহ্বায়ক কমিটি।’ অস্বাভাবিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ডেসটিনির মডেল নিয়ে হাজির হয়েছিল এমএলএম কোম্পানি ইউনিপে টু ইউ। অল্প সময়ের মধ্যে নেটওয়ার্কিং সম্প্রসারণ করে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এ দুই প্রতিষ্ঠান। গ্রাহক প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ হতে থাকলে কড়াকড়ি আসে এমএলএম ব্যবসায়। প্রণয়ন হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এরপর শুরু হয় প্রতারণার নতুন রূপ। কখনো ক্ষুদ্র ঋণ, কখনো কো-অপারেটিভ সোসাইটি বা কো-অপারেটিভ ব্যাংক, আবার কখনো মাল্টিপারপাস সোসাইটি নানা নামে শুরু হয় আর্থিক প্রতারণা। এমএলএমের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসা দেশের সব এলাকায়ই ছোট আকারে গড়ে উঠছে। এগুলো অনেকটা প্রকাশ্যেই কার্যক্রম চালিয়ে যায়। কিন্তু প্রতারকদের হাতে বহুসংখ্যক মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ার পর অভিযোগ সামনে এলে কেবল তখনই টনক নড়ে নিয়ন্ত্রকদের। এমএলএম ব্যবসার নামে দীর্ঘদিন প্রতারণা চলে এলেও ডেসটিনির কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আগে এ নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য হয়নি। পরে ডেসটিনির প্রতারণা জানাজানি হলে বেশ চাঞ্চল্য তৈরি হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও কিছুটা নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ডেসটিনি বা অন্যান্য এমএলএম প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতারিত লাখ লাখ মানুষ এখনো অর্থ ফেরত পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফরমে গ্রাহকদের সবচেয়ে আগ্রহের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ইভ্যালি। ২০০-৩০০ শতাংশ ডিসকাউন্ট অফারের সুযোগ নিতে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহকরা। আকর্ষণীয় অফারের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বড় ডিসকাউন্টের পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়ায় গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে। অস্বাভাবিক মূল্যছাড় দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনাকারী ইভ্যালির ব্যবসায়িক পলিসি নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন ওঠে। এর প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইভ্যালির মূলধন ও ব্যবসায়িক পলিসি জানতে তৎপর হয়ে ওঠে। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের দেনার বিপরীতে ইভ্যালির মূলধন যৎসামান্য থাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও দায়ের বিবরণী চেয়ে পাঠায়। এতে দেখা যায়, গত ১৫ই জুলাই পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট দায় ৫৪৩ কোটি টাকা। ইভ্যালির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের স্থাবর সম্পত্তি ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আর অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার ৪২৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে ইভ্যালির ব্র্যান্ড মূল্য। ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা অদৃশ্যমান সম্পত্তি। এছাড়া ২ লাখ ৮ হাজার গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৩১১ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে সংক্ষুব্ধ গ্রাহকের মামলায় গত বৃহস্পতিবার আটক হন ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মোহাম্মদ রাসেল। তাদের গ্রেপ্তারে স্বস্তির চেয়ে হতাশাই কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের। কারণ, বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগের পর সেই অর্থ পকেটে ফেরতের কোনো নজির নেই।