কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নার্সারিতে চারা উত্তোলন, প্রজাতি বিশ্লেষণ, চারা রোপণের প্রক্রিয়া ও চারার পরিচর্যা শিখতেও এখন বিদেশে যেতে হয়। চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে ১০ কর্মকর্তা এই কাজের প্রশিক্ষণ নেবেন। তিন সংস্থার ১০ কর্মকর্তার এই প্রশিক্ষণে মাথাপিছু ১০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। অন্য দিকে, সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ২৪৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা খরচের এই প্রকল্পের কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। অথচ এক শ’ কোটি টাকা খরচের কোনো প্রকল্প হলেই সমীক্ষা বাধ্যতামূলক বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ, নদীর তীর ও খাল রক্ষাকল্পে সবুজায়ন করা হবে তীরগুলোতে। এ জন্য সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২৪৭ কোটি ৭৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয়ে সবুজায়ন প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের দুইজন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাতজন, পরিকল্পনা কমিশনের একজনকে নিয়ে মোট ১০ জনের একটি স্টাডি ট্যুর টিম করা হবে। তারা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন। সেখানে সর্বোচ্চ ১০ দিন এই ট্যুর করবেন তারা। এতে মাথাপিছু ১০ লাখ টাকা হিসাবে এই খাতে খরচ ধরা হয়েছে এক কোটি টাকা। চারা উৎপাদন, উত্তোলন ও রোপণ শিখতে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশন থেকে আপত্তি তোলা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা। প্রকল্পটি তিন বছরে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, বাঁধের ঢাল ও খালের পাড় রক্ষাকল্পে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজায়ন, উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধক তৈরি, বনজসম্পদ বৃদ্ধি, জ্বালানি কাঠের সরবরাহ বৃদ্ধি, ফলের চাহিদা পূরণ, ওষুধি ও বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির বৃক্ষ সংরক্ষণ এবং পাখির অভয়ারণ্য তৈরি। এছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্বন সিংক, বজ্রপাতের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস এবং বাঁধ-রেগুলেটর সাইটের সৌন্দর্যবর্ধন।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, ৫৬ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৬টি বৃক্ষ চারা উৎপাদন ও সরবরাহ, ৫৮ লাখ ১০ হাজার ২৩০টি উৎপাদিত চারা পরিবহন, রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। ৯টি জলযান কেনা।
ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৬ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৬টি বৃক্ষ চারা উৎপাদন ও সরবরাহে ব্যয় হবে ১১ কোটি ৬১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। প্রতিটিতে খরচ হবে ২০ টাকা ৬৫ পয়সা। ৫৮ লাখ ১০ হাজার ২৩০টি উৎপাদিত চারা পরিবহন, রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যাবে ২০০ কোটি ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। প্রতিটি গাছের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪৫ টাকা ২৭ পয়সা। এক দফা সেমিনার ও কনফারেন্সের জন্য দুই কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। আর সাইনবোর্ডসহ প্রচার বিজ্ঞাপনে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আউটসোর্সিং থেকে সেবা কেনার জন্য এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এসব ব্যয়কে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ যৌক্তিক পর্যায়ে নেয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইং থেকে বলা হয়েছে।
সবুজায়নে বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে ৯টি জলযান কেনার জন্য ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ৯টি জলযানের জন্য দেড় কোটি টাকার জ্বালানি খরচ ধরা হয়েছে। এই জলযান মেরামতে ধরা হয়েছে ৯ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের সাথে জলযানের কী সম্পর্ক সেচ উইং তা জানতে চেয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা দফতরে জ্বালানি খরচ ৭৬ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মপ্রধান বলছেন, কর্মবণ্টন অনুযায়ী বনায়ন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়ন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ ও নদীর তীর সংরক্ষণমূলক কাজ বাস্তবায়নকালে সীমিত পরিসরে বন বিভাগের পরামর্শক্রমে বনায়ন করে। বনায়নের ব্যাপারে মাটির ধরন সম্পর্কে বন বিভাগেরই দক্ষতা রয়েছে। তাই এই কাজ বা প্রকল্প বন বিভাগের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে।
প্রকল্পটিতে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। একনেক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একনেক কর্তৃক অনুমোদনযোগ্য অর্থাৎ এক শ’ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের আগে আবশ্যিকভাবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। খুলনা বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন বিভাগের মাধ্যমে এই সমীক্ষা করতে হবে।
এ ব্যাপারে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস এবং পাউবোর মহাপরিচালক ফজলুর রশীদের সাথে ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।