পদত্যাগ করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিন। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন হারানোর পর আজ সোমবার পদত্যাগ করেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ইতি ঘটলো তার দেড় বছরেরও কম সময়ের রাজত্বের। শুধু তা-ই নয়। একই সঙ্গে তিনি নতুন এক রেকর্ড গড়েছেন। তা হলো এ যাবতকালের মধ্যে মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে কম সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী তিনি। নিজের দলের ভিতর ষড়যন্ত্র করে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদকে ক্ষমতাচ্যুত করান কার্যত তিনিই। এরপর নিজ দলের কিছু সদস্য এবং বিরোধীদের সমর্থন নিয়ে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হন ২০২০ সালে।
কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের সময় থেকেই তিনি তোপের মুখে ছিলেন। পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা কৌশলে এড়িয়ে যান।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তার মনে ভয় ছিল, তিনি যে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, তা যেকোনো সময় পল্টি খেতে পারে। পার্লামেন্টে আস্থাভোটের ডাক দিতে পারেন বিরোধীরা। এ জন্যই তিনি নানা কৌশলে পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা থেকে বিরত ছিলেন। সেই সঙ্গে করোনা মহামারি তার কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসে। এই উসিলায় তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন। ফলে পার্লামেন্টও স্থগিত হয়ে যায়। এরই মধ্যে কয়েকবার বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম দাবি করে বসেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন তার আছে। তিনি সরকার গঠন করতে চান। তা নিয়ে রাজপ্রাসাদে দৌড়াদৌড়ি হয়। কিন্তু গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া যায়নি। ফলে প্রধানমন্ত্রী থেকে যান মুহিদ্দিন ইয়াসিন।
সম্প্রতি তার ক্ষমতাসীন জোটে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (উমনো) কমপক্ষে ৮ জন এমপি প্রধানমন্ত্রীর ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে ফাঁদে পড়ে যান মুহিদ্দিন। বাধ্য হয়ে তিনি গত শুক্রবার প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ঘোষণা দেন। তবে তিনি বিরোধী দলীয় এমপিদের সমর্থন প্রত্যাশা করেন, যাতে তিনি ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেন। কিন্তু তার সেই ‘এসওএস’ বার্তা বা বাঁচানোর আর্তি কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় না। ফলে রোববার অনলাইন মালয়েশিয়াকিনির উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আজ সোমবার তিনি পদত্যাগ করবেন। ঠিকই তাই ঘটেছে।
বার্তা সংস্থা এপি বলেছে, মুহিদ্দিনের বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী জামালুদ্দিন ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, মন্ত্রীপরিষদ আজ আমাদের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছে রাজার কাছে। রাজার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন সাক্ষাৎ করে রাজপ্রাসাদ ছাড়ার অল্প সময় পরে তিনি এসব কথা লিখেছেন। ক্রীড়া বিষয়ক উপপমন্ত্রী ওয়ান আহমেদ ফয়সাল ওয়ান আহমেদ কামাল মালয়েশিয়ার জন্য যে সেবা দিয়েছেন মুহিদ্দিন, সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ফেসবুকে দেয়া একই পোস্টে তিনি মুহিদ্দিনের নেতৃত্বেরও প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু মুহিদ্দিন ইয়াসিন পদত্যাগ করলেন এমন এক সময়ে যখন করোনা মহামারিতে মালয়েশিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। তবে তার মধ্যেই রাজনৈতিক নেতারা শীর্ষ এই পদ পাওয়ার দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মুহিদ্দিনকেই সমর্থন করছেন তার ডেপুটি ইসমাইল সাবরি। এর মধ্য দিয়ে তিনি মুহিদ্দিনের সরকার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এখানে উল্লেখ, মালয়েশিয়ায় সরকার করোনা মহামারি মোকাবিলা করছে নাজুকভাবে। বিশ্বের মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মুত্যুর হার যেসব দেশে, তার মধ্যে অন্যতম মালয়েশিয়া। সাত মাসের জরুরি অবস্থা, জুনের পর লকডাউন দেয়ার পরও এ মাসে সেখানে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এসব নিয়ে জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছিল।
আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন রাজপ্রাসাদে পৌঁছার আগেই স্থানীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, দেশটির পুলিশ প্রধান, নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং এটর্নি জেনারেলকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠানো হয়। রাজপ্রাসাদে যাওয়ার আগে আজই মন্ত্রীপরিষদের একটি বৈঠক করেন মুহিদ্দিন। প্রাসাদে প্রবেশের গেটে সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। ভিতরে প্রবেশ করেন এবং ৪০ মিনিট পরে বেরিয়ে আসেন। ধারণা করা হয়, মন্ত্রী জামালুদ্দিন পদত্যাগের যে কথা জানিয়েছেন, তা জমা দিতেই তিনি রাজার কাছে গিয়েছিলেন। আজই আরও পরে সংবাদ সম্মেলন করার কথা তার।
মালয়েশিয়ায় ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের মালয়েশিয়ার রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্রিজিত ওয়েলস বলেছেন, সময়ক্ষেপণ করছিলেন মুহিদ্দিন। এখন দেখার বিষয় কিভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় এবং সংকট মোকাবিলা করা হয়।