কেন অবহেলার পাত্র জানা হলো না

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তারা। গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধ। নির্যাতিত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। সেই প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনেকে আজ বেঁচে নেই। অনেকে জীবন সায়াহ্নে উপনীত। অভাব, অনটন ও দুঃখকে সঙ্গী করেই চলছে তাদের অনেকের জীবন। থাকার মতো ঘর নেই, দুবেলা খাবারের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই।

১৫ আগস্টের প্রতিরোধযোদ্ধাদের একজন নেত্রকোনার কলমাকান্দার বড়ইউন্দের অশোক তালুকদার। তিনি বলেন, জিয়া (জিয়াউর রহমান) আমাদের দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়েছিল। এ নিয়ে আর দুঃখ করি না। দুঃখ হয় এ জন্য যে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তবু সেই দুষ্কৃতকারীর বদনাম ঘুচে নাই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে অশোক তালুকদার বলেন, পিতৃহত্যার বদলা নেওয়ার জন্য আমরা জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম প্রতিরোধযুদ্ধে। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন। যারা আছি, বয়স আর অসুস্থতা মিলে এখন তো প্রায় সবারই যাই যাই অবস্থা। কিন্তু কেন দেশের কাছে অবহেলার পাত্র হলাম, তা জানা হলো না আজও।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার প্রতিরোধযোদ্ধা স্বপন চন্দ। জাতির জনক হত্যার প্রতিবাদে ওই যে বাড়ি ছেড়েছিলেন, আর ফিরে যাননি মাতৃভূমিতে। তার শারীরিক অবস্থ খুবই খারাপ। চলাফেরা তেমন করতে পারেন না। স্বপন চন্দের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি যেন যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে যান। প্রতিরোধের দিনগুলোর কথা শোনান। শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখান। আবার নিজেদের অবহেলিত মনে করে কাঁদেনও।

স্বপন চন্দ বলেন, আমাদের সহযোদ্ধাদের কেউ ভালো নেই; রোগে শোকে, দারিদ্র্যে জীবনযাপন করছেন। আমাদের কেউ খোঁজ রাখে না। অথচ অনৈতিকভাবে বেড়ে ওঠা মানুষের কী কদর, কী আওয়ামী লীগে, কী বাংলাদেশে! এই যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো একটা মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন, এখানেও কী ভূমিহীন প্রতিরোধযোদ্ধাদের একটা ঘর দেওয়া যেত না? আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয় না। জানলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন।

নেত্রকোনার দুর্গাপুর সদরের সাধুপাড়া গ্রামের প্রতিরোধযোদ্ধা আমজাদ হোসেন। চলাফেরা করতে পারেন না ঠিকমতো, কানেও শোনেন না তেমন। দুই ছেলে দুই মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। এক ছেলে রাজমিস্ত্রি, অন্য ছেলে ভ্যানচালক। স্ত্রী ও বড় ছেলেও অসুস্থ। ১৫ আগস্টের পর একবার এবং সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি সরকারের সুদৃষ্টি চান।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আকনপাড়া গ্রামের প্রতিরোধযোদ্ধা রঞ্জন সরকার জীবিকার তাগিদে থাকেন ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে একটি মনোহারি দোকানে চাকরি করেন। তার একমাত্র ছেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে পড়ছেন। দোকানে চাকরি করে ছেলেকে সামান্যই সহায়তা করতে পারেন। সংসার ও নিজের চিকিৎসার খরচ চালিয়ে তিনি পেরে উঠছেন না। রঞ্জন সরকার বলেন, ভিটেমাটি ছাড়া আমার কিছু নেই। আমার সবচাইতে বড় সম্পদ এখন আমার একমাত্র সন্তান। তাকে যদি মনমতো পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারতাম, তা হলে আর কিছু চাওয়ার থাকত না। কিন্তু পারছি না।

হালুয়াঘাটের আরেকজন প্রতিরোধযোদ্ধা ভানুরঞ্জন সরকার। স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে চলছে সংসার। বিবেকের তাড়নায় তিনি জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। এখন তার অসহায়ত্বের দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেন না। তিনি জানান, ছেলের সামান্য আয়ে সংসার কোনোরকম চলে যাচ্ছে; বাড়ছে ঋণের বোঝা। বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থতা এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। শরীর আর চলছে না।

জাতির পিতা হত্যার বিচারের দাবিতে যিনি সবচেয়ে আলোচিত তার নাম বিশ^জিৎ নন্দী। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে দুবার করে চারবার ফাঁসির আদেশ এবং কার্যকর করার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতিও হয়। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচ এবং ভাগ্যের কারণে তিনি বেঁচে যান। তবে জেলে থেকেছেন প্রায় একযুগ। সেই সঙ্গে তাকে এবং তার পরিবারের প্রতি করা হয়েছে অত্যাচার। তবু জাতির জনক হত্যার বিচারের প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় তার সহকর্মীদের ওপর জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামলে শুধু শারীরিকভাবেই টর্চার করা হয়নি; সহায়-সম্বলও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এদের অনেকেই এখন নিঃস্ব, অসুস্থ। অনেকে মারা গেছেন। তাদের খবর কেউ রাখে না। তিনি বলেন, আমি ভাগ্যবান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আমি যুক্ত। জাতির জনক হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলাম। এসব করতে গিয়ে যা কিছু হারিয়েছি, যা কিছু আছে তা নিয়েই বেঁচে আছি। ভালো আছি!

এ ছাড়া সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের সুকেশ সরকার, সুবল সরকার, কাইতকান্দার বিধুভূষণ, কৈলাটির লালচান মিয়া, মধ্যনগরের সাড়ার কোনার সুনকুল সরকার, নেত্রকোনার বারহাট্টার রামভদ্রপুরের কাজল সরকার, ময়মনসিংহের গৌরীপুরের নিখিল সাহা, জামালগঞ্জের মদিনাকান্দির রাসেন্দ্র তালুকদারসহ বহু প্রতিরোধযোদ্ধা অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না।

অন্তত ১০ জন প্রতিরোধযোদ্ধা জানান, বছর দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এক লাখ টাকা করে চেক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কী এক কারণে সেই চেক এই প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে পৌঁছেনি। এতে তারা ক্ষুব্ধ এবং অপমানিত হয়েছেন বলে জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *