মাদক আইনে মামলা পরীমনি রাজ, পিয়াসা একই চক্রে

Slider বিনোদন ও মিডিয়া


কয়েক দিন আগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বিতর্কিত মডেল পিয়াসার সঙ্গে চিত্রনায়িকা পরীমনি ও চলচ্চিত্রের বিতর্কিত প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তারা একসঙ্গে কাজ করতেন বলে র‌্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবন, উঠতি মডেল ও নায়িকাদের দিয়ে ব্ল্যাকমেইল আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। পরীমনির সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিশুরও যোগাযোগ ছিল। তবে পরীমনির দুবাই ভ্রমণকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। পরীমনিকে চলচ্চিত্রে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল প্রযোজক রাজের। বনানীতে পরীমনি যে ফ্ল্যাটে বসবাস করেন সেই ফ্ল্যাটটি রাজ তাকে কিনে দেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজ জানিয়েছেন, বিখ্যাত একটি ম্যাগাজিনে পরীমনির ছবি আসার পেছনে জোর লবিং করেছিলেন তিনি। ওই ম্যাগাজিনে তার নাম আসার পর পরীমনি দেশে ও বিদেশের মিডিয়ায় নতুনভাবে আলোচনায় আসেন।

ওই ম্যাগাজিনে পরীমনি প্রায় ১০০টি ছবি পাঠিয়েছিলেন। উঠতি মডেল এবং চলচ্চিত্রে যারা নতুন অভিনয় করতে চায় তাদের সঙ্গে নানা কৌশলে সখ্য তৈরি করতেন প্রযোজক রাজ। তার মোবাইলে বিভিন্ন মডেল ও নায়িকাদের নানারকম ছবি দেখতে পেয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের ধারণা, ওই ছবিগুলো ব্ল্যাকমেইল এবং ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো।

এছাড়াও রাজের উচ্চাভিলাষ ছিল যে, ভারতের চলচ্চিত্রের যে রাজকাপুর পরিবার আছে সেই রাজকাপুর পরিবারের মতো তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে। জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেছিলেন প্রযোজক রাজ। এরপর ঢাকায় এসে বিভিন্ন্ন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি চলচ্চিত্রের রঙিন জগতে আসেন। ছবিতে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা হওয়া তার স্বপ্ন ছিল। পরে তা হতে না পেরে তিনি নিজেই তার টাকা চলচ্চিত্রে লগ্নি করেন।

গত বুধবার বিকালে বনানীতে পরীমনির বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় পরীমনির বাসা থেকে ১৯ বোতল বিদেশি মদ, ৪ গ্রাম আইস, ১ ব্লট এলএসডি, সিসা জব্দ করা হয়। এরপর প্রযোজক ও অভিনেতা নজরুল ইসলাম রাজের বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মাদক ও সিসার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এছাড়াও তাদের আরও দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বনানী থানা সূত্রে জানা গেছে, পরীমনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মাদক আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরও দুটি মামলা প্রক্রিয়াধীন।

র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরীমনির বাসায় ও প্রযোজক রাজের বাসায় বসতো প্রত্যেক দিন ডিজে পার্টি। এসব পার্টিতে গুলশান, বনানী ও ধানমণ্ডির উচ্চবিত্তের যুবকরা অংশ নিতো। পরে রাজসহ তাদের লোকজন কৌশলে নানারকম ছবি তুলে তাদের ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করতেন।

সূত্র জানায়, কয়েক দিন আগে এক চাকরিজীবীর স্ত্রী রাজের ডিজে পার্টিতে গিয়ে এ চক্রের ফাঁদে পড়েন। পরে পর্ন্যগ্রাফির অভিযোগে ওই চাকরিজীবী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে যায় র‌্যাব ও পুলিশ। সূত্র জানায়, রাজের ফাঁদে পড়েন প্রায় ৫০ জন উঠতি মডেল। তাদের নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হয়।

রাজের যে মাল্টিমিডিয়া প্রডাক্টশন হাউস আছে সেটি র‌্যাব সিলগালা করে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফির অভিযোগ আনা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, পরীমনির বাসায় গড়ে উঠেছিল একটি মিনি বার। সেখানে রাত-বিরাতে পার্টি বসতো। গান-বাজনা হতো। পার্টি শেষে তারা আবার রাতের ঢাকায় গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হতেন।

সূত্র জানায়, পরীমনিকে যারা মাদক সরবরাহ করতো তাদের নাম এখন র‌্যাবের হাতে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়াও পরীমনি র‌্যাবের কাছে দাবি করেছেন যে, তার কাছে মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে। কিন্তু সেই লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগে।

এদিকে, পরীমনি ও রাজকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে উত্তরার র‌্যাবের সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত ৩রা আগস্ট রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং তার সহযোগী মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকার গুলশান, বারিধারা ও বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টি আয়োজনের বেশ কয়েকটি স্থানের তথ্য প্রদান করে। ফলে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

তিনি আরও জানান, গত বুধবার রাজধানীর বনানী এলাকায় বিকাল হতে রাত পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনি, মো. নজরুল ইসলাম ওরফে রাজ, আশরাফুল ইসলাম দীপু ও মো. সবুজ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি আরও জানান, পরীমনিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পিরোজপুরের কলেজে (এইচএসসি) জীবনে অধ্যয়নরত অবস্থায় চিত্রজগতে প্রবেশ করেন। তিনি ২০১৪ সালে চিত্রজগতে অন্তর্ভুক্ত হন। এ পর্যন্ত তিনি ৩০টি সিনেমা এবং ৫-৭টি টিভিসিতে অভিনয় করছেন।

তিনি আরও জানান, পরীমনি ২০১৬ সাল হতে অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। তার ফ্ল্যাট হতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি নিয়মিত অ্যালকোহল সেবন করে থাকেন। মাত্রাতিরিক্ত সেবনের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বাসায় একটি মিনি বার স্থাপন করেছেন। মিনি বার থাকায় তার ফ্ল্যাটে ঘরোয়া পার্টি অয়োজন পরিপূর্ণতা পেত বলে তিনি জানান। গ্রেপ্তারকৃত মো. নজরুল ইসলাম রাজসহ আরও অনেকে তার বাসায় অ্যালকোহলসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের সরবরাহ করতেন।
তিনি আরও জানান, নজরুল ইসলাম রাজকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ১৯৮৯ সালে খুলনার একটি মাদ্রাসা হতে দাখিল পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকায় গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন বলে দাবি করেন। অতঃপর তিনি বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য ও ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি শোবিজ জগতেও তার অনুপ্রবেশ ঘটে। বিভিন্ন সিনেমা ও নাটকে তিনি নানান চরিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নামে-বেনামে প্রযোজনায় যুক্ত হন। রাজ মাল্টি মিডিয়া নামেও তার একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসায়িক জগত ও চিত্রজগতের দুই ক্ষেত্রে তার সংযোগ থাকায় তিনি অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নিজ অবস্থানের অপব্যবহার করেন।

তিনি আরও জানান, রাজ ইতিপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানের সহযোগিতায় ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। ওই সিন্ডিকেটটি রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীতে পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে থাকে। ওই পার্টিতে অংশগ্রহণকারীদের নিকট হতে সিন্ডিকেট সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন।

সংবাদ সম্মেলনে এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাবের পরিচালক (গোয়েন্দা) লে. কর্নেল মো. খাইরুল আলম, র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মোস্তাকিম এবং র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের সহকারী পরিচালক মেজর রইসুল আজম মনি ও এএসপি আ.ন.ম ইমরান খান ইমন প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *