হঠাৎ করে বিভিন্ন মডেলের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকদিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকজন মডেল ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারের পর আরও অনেকের নাম উঠে আসতে শুরু করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বসবাস করা এই মডেলদের সঙ্গে সমাজের উঁচুস্তরের ব্যক্তিদের যোগসাজশ পাওয়া যাচ্ছে। ভুয়া পরিচয়ের প্রভাব খাটিয়ে অল্প দিনে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন তারা। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীর, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ থেকে শুরু করে পরীমনি পর্যন্ত সবার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
গত কয়েকদিনে ধরে আটক হওয়া মডেলদের সঙ্গে তাদের সহযোগী হিসেবে শরীফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান ও মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকেও গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। পরীমনিকে আটকের পর সহযোগী ও রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকেও আটক করেছে র্যাব। এই তালিকায় আরও বেশ কয়েকজন মডেল অভিনেত্রীর নাম রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে ঠিক কি কারণে আকস্মিকভাবে এসব অভিযান, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে অনেক কাহিনী।
বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, বর্তমানে মডেলদের অনেকেই বিভিন্ন পার্টির নামে গোপন ক্যামেরায় সমাজের বিত্তশালীদের অসতর্ক মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরে এগুলো তাদের পরিবারের স্বজন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিত্তশালীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করতেন। বিত্তশালীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করলেও যে থেমে যেতেন, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময়ে আরও বড় বড় আবদান চেয়ে বসতেন তারা। বিভিন্ন এলাকায় এ চক্রের সদস্যদের এজেন্টও রয়েছে। তাদের হাত ধরেই সুন্দরী নারীরা হয়েছে ওঠেন পার্টি গার্ল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানা যায়, দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি সম্প্রতি মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের চক্করে পড়েন। তার অসতর্ক অবস্থায় তোলা কিছু ছবিকে পুঁজি করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এদের কাছ থেকে রেহাই না পেয়ে ওই ব্যাংকের এমডি বিষয়টি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জানিয়ে আইনি প্রতিকার চান। এরপর বেরিয়ে আসে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, শুধু ওই ব্যাংকের এমডি নন, এখন পর্যন্ত পিয়াসা ও মৌয়ের মোবাইল ফোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৭টি ভিডিও পাওয়া গেছে। এসব ভিডিওতে কয়েকজন শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর বখে যাওয়া সন্তানদের অসতর্ক মুহূর্তের ছবি রয়েছে। তাই এসব গোপন ভিডিও অন্যদের হাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। চক্রটির প্রতারণা থেকে ফেঁসে যাওয়া ব্যক্তিদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য এ অভিযান।
অভিযোগের পাল্লা ভারী হওয়ার পরপরই বিষয়গুলোতে আরও গভীরভাবে মনোযোগ দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এসব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ পায়। পরে সবুজ সংকেত মেলাতে তাদের গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার তালিকায় আরও ৩৫ থেকে ৪০ জন রয়েছেন। মূলত অসতর্ক মুহূর্তের ছবি ব্যবহার করে ফাঁসানোর এ চক্রটিকে একটি বার্তা দিতে চান সংশ্নিষ্টরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, অসতর্ক অবস্থায় তোলা ছবি ও ভিডিও পুঁজি করে অনেক বিতর্কিত মডেল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে মাসোহারা নিতেন। কেউ কেউ দামি গাড়ি নিয়েছেন। অনেককে বিদেশ ভ্রমণের পুরো খরচও দেওয়া হয়। মূলত বিতর্কিত মডেলদের মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে যাদের অসতর্ক মুহূর্তের ভিডিও রয়েছে, তা জব্দ করা হবে। আরও কয়েকজন মডেল গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছেন।
উঠতি মডেলদের যারা ব্যবহার করতেন, পার্টি আয়োজনের জন্য তাদের বিভিন্ন ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতি রাতে সেখানে পার্টির আয়োজন করা হয়। সেখানে চড়া দামে বিত্তশালীদের কাছে বিদেশি মদও বিক্রি করে আয় করা হয় লাখ লাখ টাকা। আবার সরকারি-বেসরকারি কাজ বাগিয়ে নিতে কেউ কেউ উঠতি মডেল ও নায়িকাদের ব্যবহার করেন।
সূত্রের দাবি, গতকাল র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার মিশু ঢাকার উঠতি মডেল ও নায়িকাদের নিয়ে দেশ-বিদেশে ‘বিশেষ পার্টির’ আয়োজক। তার বিলাসবহুল গাড়ির শোরুম আছে। মোহাম্মদপুরের সাবেক কাউন্সিলর রাজীবের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। মিশুর মাধ্যমে রাজীব বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রটি আরও দাবি করে, গুলশানকেন্দ্রিক এ চক্রের আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম রাজ। প্রযোজক হিসেবে তার কিছুটা পরিচিতি রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে তার পেশা করপোরেট কোম্পানির বড় কর্তাদের সঙ্গে ভিন্ন উদ্দেশ্যে উদীয়মান মডেলদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বিনিময়ে কমিশন পান তিনি। এ জগতের আরও দু’জন- নাজিম সরকার ও তুহিন কাজী। তাদের ব্যাপারেও গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে। ঢাকা ছাড়াও গাজীপুরকেন্দ্রিক তাদের চক্র সক্রিয়।