ঢাকাঃ আলোচিত মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অর্ধশত সুন্দরী তরুণী। তাদের টোপ দিয়েই ধনীদের ফাঁদে ফেলা হতো। রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে বসানো হতো মাদকের আসর। সেখানে চলত অনৈতিক কর্মকাণ্ড। পার্টিতে অংশ নেয়া ‘অভিজাত’ শ্রেণীর লোকদের সাথে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নেয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এসব অনৈতিক কাজে জড়িত কথিত মডেলদের ৫০ জনের নাম-পরিচয় ইতোমধ্যে র্যাবের হাতে রয়েছে। এসব কথিত মডেল ও টিভি কর্মীকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করতেন শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান। র্যাব জানায়, মঙ্গলবার মধ্যরাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে পিয়াসার সহযোগী শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান (৩১) ও সহযোগী মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে (৩৯) গ্রেফতার করা হয়। এ সময় একটি আগ্নেয়াস্ত্র, ছয় রাউন্ড গোলাবারুদ, ১৩ হাজার ৩০০ পিস ইয়াবা, একটি বিলাসবহুল ফেরারি মডেলের গাড়ি, সিসার সরঞ্জামা, দুইটি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও এটিএম কার্ড, পাসপোর্ট এবং ভারতীয় মুদ্রা ৪৯ হাজার ৫০০ জাল রুপি উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, মরিয়ম আক্তার মৌ একে একে ১১টি বিয়ে করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। আর সেই স্বামীদের কাছ থেকে হাতিয়েছেন অঢেল সম্পদ। মাদক মামলায় গ্রেফতারের পর মডেল মৌয়ের সাথে ভিআইপিদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। একই সাথে অঢেল সম্পদের উৎস খুঁজে দেখছেন তারা। এরই মধ্যে তার বাসার সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করেছে পুলিশ।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মৌয়ের সর্বশেষ স্বামী একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ধনাঢ্যদের ফাঁদে ফেলে তিনি বিয়ে করতেন। বিপুল পরিমাণ সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার পর আরেকজনের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেন।
গত রোববার রাতে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর বারিধারার ৯ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্যসহ ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। এ সময় পিয়াসার ঘরের টেবিল থেকে চার প্যাকেট ইয়াবা (কত পিস জানা যায়নি), রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে ৯ বোতল বিদেশী মদ, ফ্রিজে একটি আইসক্রিমের বাক্স থেকে সিসা তৈরির কাঁচামাল এবং বেশ কয়েকটি ই-সিগারেট উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া পিয়াসার কাছ থেকে চারটি স্মার্টফোন জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়।
পিয়াসার দেয়া তথ্যে আরেক মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। এ সময় তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার করা হয়। মৌর বাসার ভেতরে ড্রয়িং রুমের পাশেই একটি মিনি বারের সন্ধান পায় পুলিশ। বাসার বেডরুমের একটি ড্রয়ার থেকে পাঁচ প্যাকেট ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ওই বেডরুমের ভেতরে আরেকটি ড্রেসিং রুম থেকে অন্তত এক ডজন বিদেশী মদের বোতল উদ্ধার করা হয়।
দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও মোহাম্মদপুরে পাঁচতলা আলিশান বাড়ি রয়েছে মৌর। নেক্সাস, পাজেরো ও টয়োটা ব্র্যান্ডের তিনটি দামি গাড়িও আছে তার। মৌ মডেলিং পেশার আড়ালে ব্ল্যাকমেইলিং করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন বলে অভিযোগ পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। মাদক ও অনৈতিক ব্যবসায় তার সংশ্লিষ্টতার কিছু প্রমাণ ইতোমধ্যে গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে।
এ দিকে মাদক মামলায় গ্রেফতার মডেল পিয়াসা ও মৌর সাথে ‘ভিআইপিদের’ সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা পুলিশ। এ দুই মডেলকে ব্যবহার করে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধের বিষয়টিও তদন্ত করছে তারা। বিশ্লেষণ করা হচ্ছে পিয়াসা ও মৌয়ের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া সিসিটিভি ফুটেজ ও আলামত থেকে।
ঢাকা মহানগর (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো: হারুন অর রশিদ বলেন, এদের কারা এ পেশায় এনেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তারা মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ গাড়ি ব্যবহার করছে, পাঁচ হাজার স্কয়ার ফিটের বাসায় একা থাকছে। সেখানে মদের বার, সিসার বার তৈরি করছে। তাদের আয়ের উৎসটা কোথায় তা আমরা খতিয়ে দেখছি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, অভিযুক্তরা একটি চক্রের সদস্য। এ চক্রের সদস্য প্রায় ১০-১২ জন। তারা গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন ‘অভিজাত’ এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করেন। এ জন্য তারা অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পান। অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। প্রতিটি পার্টিতে ১৫-২০ জন অংশগ্রহণ করত। এ ছাড়া বিদেশেও প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করা হতো। একইভাবে উচ্চবিত্তের প্রবাসীদের জন্যও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টি আয়োজন করা হতো। তারা ক্লায়েন্টদের গোপন ছবি ধারণ করে অপব্যবহার করত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। তিনি আরো বলেন, পার্টি আয়োজনের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টের চাহিদা বা পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া হতো। এই অবৈধ আয় থেকে উপার্জন করা অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় (গাড়ির ব্যবসা, গাড়ি আমদানি ও গরুর ফার্ম) বিনিয়োগ করেছেন মিশু হাসান ও জিসান। এই ব্যবসায় তাদের গ্রুপের সদস্যদের অবৈধ আয়েরও বিনিয়োগ রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান বাংলাদেশে নামীদামি ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবসা করেন। তিনি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নিতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। তার ব্যক্তিগত দুইটি রেঞ্জ রোভার, অ্যাকুয়া, ভক্স ওয়াগন ও ফেরারিসহ পাঁচটি গাড়ি রয়েছে। তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে গাড়ির ট্যাক্স জালিয়াতি করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া জিসানের একটি গরুর ফার্ম রয়েছে। সেখানে তিনি অননুমোদিত ব্রাহমা জাতের গরু লালন-পালন করেন।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকদের টার্গেট করে আসর বসানো হতো। এই চক্রের ক্লায়েন্টের তালিকায় পিয়াসা-মৌসহ দেশী-বিদেশী ৫০ জনের নাম পাওয়া গেছে। যাদের বিদেশেও প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করে পাঠানো হতো। একইভাবে উচ্চবিত্তের প্রবাসীদের জন্যও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টি আয়োজন করে পিয়াসা-মৌর মতো কথিত মডেলদের পাঠানো হতো। আটকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে, ভারতীয় জাল মুদ্রা রাখা ও অননুমোদিত গাড়ি আমদানি ও ব্যবহারের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।