গাজীপুর: নারী পুরুষের বিয়ে হলে সংসারে সন্তান আসে। ইদানিং বিয়ে ছাড়াও জীবিত বা মৃত সন্তান আলোর মুখ দেখে। সন্তান জন্মের পর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ কোন কারনে অকার্যকর হলে আদরের সন্তান অপরাধী হয়ে যায়।
পারিবারিকভাবে কোন সন্তান পথভ্রষ্ট হলে সমাজ বা রাজনৈতিক নেতারা ওই সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে, এমন প্রত্যাশা রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানের। চিরায়ত সংস্কৃতিতে পারিবারিকভাবে অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করতে সমাজ ও রাষ্ট্র কাজ করে কিন্তু পরিবার সমাজ রাজনীতি এমনকি রাষ্ট্র যখন বেখেয়ালি হয়ে যায় তখন বেয়াদবরা অপরাধী হয়ে যায়।
বাস্তবতা বলছে, কয়েক দশকে পরিবারচ্যুত সন্তানকে ঘুণে ধরা সমাজ অপরাধী হতে কোন না কোন ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এমনকি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঘুণে ধরা সমাজে অপরাধীকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে লালন করে। তারা ভয়ংকর অপরাধী বানাতে দিধা করেনা। এই চলমান সংস্কৃতি সমাজে বখাটে বেয়াদব অপরাধীর মত মন্দ লোকদের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
পর্যালোচনা বলছে, ক্রসফায়ার একটি বেআইনি কাজ। কাউকে হত্যা করা আইন সমর্থন করেনা । অপরাধী যত বড়ই হউক তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিৎ । আবার শৃঙ্খলা বাহীনি আত্মরক্ষার জন্য যদি কাউকে মেরে ফেলে তবে সেটা আইনসিদ্ধ। আমাদের সংবিধান, সর্বোচ্চ আইন। আইনে আত্মরক্ষার অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা আছে। ফলে ক্রসফায়ার যেমন বেআইনি তেমনি আত্মরক্ষা না করে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াও বেআইনি। সুতরাং আত্মরক্ষা করে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। ফলে আইন মানবাধিকার সবসময় হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নৈতিক স্খলনের মুখোমুখি হওয়ায় কয়েক দশকে প্রতিযোগীতামূলক রাজনৈতিক ঢামাঢোলে অপরাধী ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কারনে পরিবারচ্যুত কোন বেয়াদব সন্তান সমাজ ও রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ও অপরাধ দমনে ওই সব অপরাধীদের সাধ্যমত বাঁচিয়ে রেখে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পৃষ্ঠপোষকাতায় থাকা চক্রকে আইনের মুখমুখি করা উচিৎ। একই সাথে আত্মরক্ষায় ক্রসফায়র জনিত ঘটনায় করা মামলা তদন্ত করে সমাজের ঘুণ পোকাদের আইনের আওতায় আনা দরকার । না হয় কিছু অপরাধী হয়ত ক্রসফায়ারে মারা যাবে, কিন্তু নতুন নতুন অপরাধী একই আদলে গড়ে উঠে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সব সময় বিপদের সম্মুখিন করে রাখবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে জন্ম হয়েছিল ডাকাত বাবুলের। ২০১৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হয় সে।
দুই বছরের ব্যবধানে একই স্থানে ক্রসফায়ারে নিহত হয় বাবুল ও পারভেজ। অপরাধ জগতের এই দুই ব্যক্তি পরষ্পর আত্মীয় ছিলেন। পারভেজ ডাকাতি করতে গিয়ে বাবুলের ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এক সময় বাবুলের ছোট বোন বিয়ে করে পারভেজ হয়ে যায় বাবুলের ভগ্নিপতি। গেলো শনিবার রাতে একই স্থানে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় পারভেজ। ২০১৯ সালে বাবুলের পরিবার দাবি করেছিল র্যাব বাবুলকে ধরে ক্রসফায়ার করেছে। শনিবার রাতে ক্রসফায়ার হওয়া পারভেজের পরিবার বলছে, শুক্রবার রাতে স্থানীয় গলদাপাড়া গ্রামের একটি বাড়ি থেকে পারভেজকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতার ও ক্রসফায়ার এই দুইয়ের মধ্যে মিল অমিল যাই থাকুক ডাকাত বাবুল ও ডাকাত পারভেজ দুই বছরের ব্যবধানে একই স্থানে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে, এটাই সত্য।
বাবুলের উত্থান:
জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন বাবুল ( ৩৫)। ছোটকাল থেকেই ছোটখাটো বেয়াদবিকে তার পরিবার তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তী সময় বাবুল ডাকাত হয়ে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, বাবুলের পরিবার স্থানীয় মাতাব্বরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ছেলেকে ঘরে ফিরাতে পারেনি। পরবর্তী সময় বাবুল রাজনৈতীক পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীপুর, ভালুকা ও গফরগাঁও অঞ্চলের ত্রাস হয়ে উঠে। ২০১৯ সালে র্যাবের ক্রসফায়ারে সে নিহত হয়।
পারভেজের উত্থান:
একই গ্রামের মৃত কালু শেখের ছেলে পারভেজ (২৮)। ছোটকালে পারভেজের বাবা মারা যায়। নানীর বাড়িতে বেড়ে উঠা পারভেজ ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিল। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় পঞ্চম শ্রেণির পর আর লেখা পড়া হয়নি। ২০০৫ সালে তার পরিচয় হয় বাবুলের সাথে। গড়ে উঠে সখ্যতা সেই থেকে যুগল অপরাধকর্ম শুরু । ২০১৯ সালে বাবুল ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর সে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এলাকায় প্রবেশ করে । বাবুল জীবিত না থাকায় পারভেজ তার ও বাবুলের গ্রুপের লোকজন নিয়ে একটি বিশাল বাহীনি গড়ে তুলে। খুন, চুরি, ছিনতায়, ডাকাতি, রাহাজানি সহ নানা ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে যায় পারভেজ সিন্ডিকেট। গত শনিবার রাতে বাবুলের জায়গায় ক্রসফায়ারে নিহত হয় পারভেজ।
এলাকাবাসীর না বলা কথা:
বাবুল ও পারভেজ জুটির অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একাধিক ব্যক্তি নির্যাতিত হয়েছেন। অস্ত্র টানাটানি করতে গিয়ে বাবুল ও পারভেজের সহযোগী কবির নামে একজনকে নিশংসভাবে জবাই করা হয়। নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে গেছেন আব্দুল মতিন নামে এক ব্যাক্তি। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এর ছেলের প্রজেক্ট চাঁদার জন্য দখল করলে পারভেজ ও বাবুলের বিরুদ্ধে ওই প্রজেক্টের ম্যানেজার হিসাবে মতিন মামলা করেন। এই ক্ষোভে বাবুল ও পারভেজ দিনের বেলায় পাকা রাস্তায় মতিন এর গতিরোধ করে অমানিক রক্তাক্ত নির্যাতন করে । মতিন বর্তমানে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এই ঘটনা অনেকটা একাধিক বি এন পি ও আওয়ামীলীগ নেতার সামনেই । স্থানীয় সূত্র বলছে, ২০১৯ সালে বাবুল নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাবুল ও পারভেজ এক যুবলীগ নেতার হয়ে জায়গা জমি জবর দখলের কাজ করতেন । বাবুলের মৃত্যুর পর পারভেজ একই সিন্ডিকেটের কাজে সক্রিয় ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই রাতের বেলা ৩০ থেকে ৪০টি হোন্ডা নিয়ে মহড়া দিত পারভেজ। মহড়ায় থাকা মটর সাইকেল থেকে নেমে নেমে রাস্তায় মদপান ও অস্ত্র প্রদর্শন করত তারা। রাতের এই মহড়ার নেতৃত্বে ছিল গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের এক প্রভাবশালী নেতার ছেলে । স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার নিরাপত্তা বলয়ে চলত এই রাতের উৎসব। উৎসবে চলত ইয়াবা সেবন।
এলাকাবাসী বলছেন, বাবুল পারভেজ না থাকলেও তার সহযোগীরা এলাকায় আছে। আপাতত গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে থাকলেও যে কোন সময় মহড়া শুরু হতে পারে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এক সময়ে শান্ত ও নিভৃত পল্লী এখন সন্ত্রাসের জনপদ। উঠতি বয়সে ছেলেদের দেখলে বুঝা মুশকিল কে ভালো কে মন্দ।
সাধারণ মানুষের দাবি, সন্ত্রাসী জনপদকে নিরাপদ করতে বাবুল-পারভেজের পৃষ্ঠপোষকদের খোঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা উচিৎ। না হলে সন্ত্রাসের এই জনপদ আরো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে এমন আশংকা বিদ্যমান।