চলমান একাদশ জাতীয় সংসদ মাত্র দুই বছর সাত মাসে, অর্থাৎ ৩১ মাসের মধ্যেই হারিয়েছে এর ১৭ জন সদস্যকে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র তিন দিন পরেই ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ডে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
আর সর্বশেষ গত ৩০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রবীণ সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আলী আশরাফ। মৃত্যুবরণকারী ১৭ জন এমপির ১৫ জনই আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে চার জন মারা গেছেন করোনায়। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতের কোনো সংসদই এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে, এমনকি পুরো পাঁচ বছর মেয়াদেও এতসংখ্যক সদস্যকে হারায়নি। উল্লেখ্য, আগের দশম সংসদের পুরো পাঁচ বছরে মারা যান ১৫ জন সদস্য।
চলতি একাদশ সংসদের যাত্রাই শুরু হয় এমপির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিদেশে চিকিত্সাধীন থাকা অবস্থাতেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অন্যদের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফকেও সংসদ সদস্য হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সৈয়দ আশরাফ এমপি হিসেবে শুধু যে এক দিনের জন্যও সংসদে যেতে পারেননি, সেটিই নয়; সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি শপথও নিতে পারেননি। এমনকি একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
চলতি সংসদ বিরোধীদলীয় নেতাকেও হারিয়েছে। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন সংসদের তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। চিকিত্সাধীন থাকাবস্থায় এমপি হিসেবে শপথ নিতে হুইল চেয়ারে করে একদিন তিনি সংসদ ভবনে গেছেন। আর বিরোধীদলীয় নেতা এবং এই সংসদের সদস্য হিসেবে সংসদে যেতে পেরেছেন একদিন, তা-ও মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য। ঐ দিনই সংসদ ভবনে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিনি তার কক্ষে নিজ আসনে কয়েক মিনিটের জন্য বসতে পেরেছিলেন।
একাদশ সংসদের এ পর্যন্ত ১৩টি অধিবেশন বসেছে। এর মধ্যে খুব কম অধিবেশনই ছিল, যেটির প্রথম বৈঠক কোনো না কোনো এমপির মৃত্যুতে মুলতবি করতে হয়নি। একের পর এক সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনাও সংসদে শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘একের পর এক আমরা সংসদ সদস্যকে হারাচ্ছি। এটা অত্যন্ত কষ্টের ও বেদনার।’
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের বিস্তার বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে শতাধিক সংসদ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় মৃত্যু হয়েছে বর্তমান সংসদের চার জন সদস্যের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন কুমিল্লা-৫ আসনের পাঁচবারের এমপি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু। তার আগে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে গত ৪ এপ্রিল স্ট্রোক করে মারা গেছেন ঢাকা-১৪ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক। করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১১ মার্চ মারা যান সিলেট-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী।
এর আগে করোনার প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের ১৩ জুন মারা যান সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এর কিছুদিন পর গত বছরেরই ২৭ জুলাই করোনায় মারা যান নওগাঁ-৬ আসনের ইসরাফিল আলম। করোনার প্রথম ঢেউয়ে টেকনোক্র্যাট কোটায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হওয়া শেখ মুহম্মদ আবদুল্লাহও মৃত্যুবরণ করেন।
সংসদ সচিবালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের এমপি মোজাম্মেল হোসেন (বাগেরহাট-৪), ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান (বগুড়া-১), ২১ জানুয়ারি সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক (যশোর-৬) ও ২ এপ্রিল মারা যান সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ (পাবনা-৪)। গত বছরের ৬ মে হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫) এবং ১০ জুলাই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (ঢাকা-১৮) মারা যান।
একাদশ সংসদের প্রথম বছরে ২০১৯ সালের ৯ জুলাই মারা যান আওয়ামী লীগের এমপি রুশেমা বেগম (মহিলা আসন-৩৪)। একই বছরের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি মঈনউদ্দীন খান বাদল (চট্টগ্রাম-৮), ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের মো. ইউনুস আলী সরকার (গাইবান্ধা-৩) মারা যান।
সংরক্ষিত ৫০টি মহিলা আসনসহ সংসদের মোট সদস্যসংখ্যা ৩৫০ জন। এর মধ্যে ১৭ জনই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। রেওয়াজ অনুযায়ী বর্তমান বা সাবেক কোনো সংসদ সদস্য মারা গেলে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা কিংবা শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ছাড়াও নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হলে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। তবে গত বছরের মার্চ থেকে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর যারা মারা গেছেন, কারোরই মরদেহ সংসদ ভবনে নেওয়া হয়নি।