সিলেটে করোনায় চলছে রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা। মৃত্যু ও শনাক্তের হার ক্রমেই ভাঙছে রেকর্ড। সেটিও আবার ঊর্ধ্বগতি। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। টানা ১৫ দিনের লকডাউনে কিছুটা কমে এলেও ঈদের অবাধ বিচরণের প্রভাব এখন পড়তে শুরু করেছে। লাফিয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের হারও। গতকাল সিলেটে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখলো সিলেটের মানুষ। এ দিন রেকর্ড সংখ্যক ১৪ জন রোগী মারা গেছেন।
একদিনে এতো মৃত্যু আগে কখনো হয়নি। একই সঙ্গে নতুন শনাক্ত হয়েছেন ৫৬৪ জন। আইসিইউ সংকট থাকায় সিলেটে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ- সিলেটে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ১৩০টি আইসিইউতে রোগী ভর্তি। এর বাইরে আইসিইউ’র জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন আরও দ্বিগুণ রোগী। এসব রোগীর স্বজনরা একটি আইসিইউ বেডের জন্য আহাজারি করলে কোথাও পান না। রোগী মারা গেছে কিংবা কেউ সুস্থ হয়ে আইসিইউ ছেড়ে দিলে তবেই ভর্তির সুযোগ থাকে। শূন্য হওয়া আইসিইউ বেডের জন্য আবার হচ্ছে তীব্র প্রতিযোগীতাও। সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউতে রোগী ভর্তি। এই হাসপাতালে আরও প্রায় ২০ জন রোগী আইসিইউ’র জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। স্বজনরা জানিয়েছেন- আইসিইউ’র পরিবর্তে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার তীব্র লড়াই চলছে। ওয়ার্ডে ও কেবিনে রেখে মুমূর্ষু হয়ে পড়া রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। যারা আইসিইউ’র অপেক্ষায় রয়েছেন তারা বয়স্কও। ফলে তাদের জন্য আইসিইউ সাপোর্ট সবচেয়ে প্রয়োজন। কামাল নামের এক স্বজন জানিয়েছেন- রোগীকে শামসুদ্দিনে রেখে তারা নগরীর বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ করলেও আইসিইউ খোজে পাচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে সাধারণ বেডে অক্সিজেন সাপোর্টে রোগীকে রাখতে হচ্ছে। ওসমানী হাসপাতালেও একই অবস্থা। টাকা ছাড় না হওয়ার কারণে ওসমানী হাসপাতালে নতুন করে ৪০০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। তবে- তিনটি ওয়ার্ডে প্রায় আড়াইশ’ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ১৬টি আইসিইউ বেড রোগীতে পরিপূর্ণ। ফলে আইসিইউ না পেয়ে এম্বুলেন্স কিংবা গাড়িতেই মারা যাচ্ছেন রোগী। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা ইতিমধ্যে নাড়া দিয়েছে সিলেটবাসীকে। সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন- ‘করোনা রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্টে রাখা এবং মুমূর্ষু হলে আইসিইউতে নেওয়াই হচ্ছে এখন একমাত্র চিকিৎসা। করোনা আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাওয়ার কারণে আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছে। এখন অক্সিজেন সংবলিত বেডও পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।’ তিনি জানান- ‘স্বাস্থ্য বিভাগ ম্যানেজ করে চলছে। গোটা দেশেই একই অবস্থা। এ কারণে নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তবে- সরকারিভাবে আরও আইসিইউ সাপোর্ট বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’ চিকিৎসা সংকটের এই সময়ে সিলেটে বেড়েছে মৃত্যু সংখ্যা। গতকাল সিলেটে সর্বোচ্চ ১৪ জন রোগী করোনায় মারা গেছেন। এর মধ্যে ১০ জনই হচ্ছেন সিলেট জেলার বাসিন্দা। বাকিদের মধ্যে ৩ জন সুনামগঞ্জের ও একজন হবিগঞ্জের। করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হটস্পটে পরিণত হয়েছে সিলেট জেলা। এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৩১ জন। এর মধ্যে কেবল সিলেট জেলায়ই মারা গেছেন ৫০১ জন। আর বাকি তিন জেলায় মৃত্যু হয়েছে ১২৯ জন। অর্থাৎ সিলেট জেলায় মৃত্যুসংখ্যা অপর তিন জেলা থেকে প্রায় ৪ গুণ বেশি। করোনায় গতকাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জের ৪৭ জন, হবিগঞ্জের ২৯ জন এবং মৌলভীবাজারে ৫৩ জন মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারি হিসাব মতে কেবল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণকারীদের হিসাবমতো এই পরিসংখ্যান। কিন্তু বাস্তবে মৃত্যুর সংখ্যা উপসর্গ মিলিয়ে দ্বিগুণ হবে। উপসর্গ নিয়ে এখনো করোনায় মৃত্যুর দ্বিগুণ রোগী মৃত্যুবরন করেছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল প্রেরিত প্রেস বার্তায় জানা গেছে- সিলেট বিভাগে নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৫৬৪ জন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে সিলেট জেলার ২০৮ জন, সিলেট ওসমানী হাসপাতালের ৪১ জন, সুনামগঞ্জ জেলার ১০৭ জন, হবিগঞ্জ জেলার ১৪৬ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ৬২ জন। নতুন করে সিলেট জেলায় ৩২ জন, সুনামগঞ্জ জেলায় ৮ জন, হবিগঞ্জ জেলায় ১ জন ও মৌলভীবাজার জেলায় ২ জন করোনা রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়াও সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৪ জন। এতে দেখা গেছে- সিলেটে হাসপাতালমুখী রোগীর স্রোত বাড়ছে। বিশেষ করে সিলেট বিভাগীয় শহরমুখী হয়েছেন প্রত্যন্ত এলাকা গ্রাম-গঞ্জের রোগীরা। জীবন বাঁচাতে রোগীদের নিয়ে অজানায় ছুটে চলেছেন রোগীরা। আইসিইউ, অক্সিজেন সাপোর্ট বেড না পেয়ে আবার অনেকেই গাড়িতে রেখে রোগীদের নিয়ে হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষায় থাকেন। চার জেলায় বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৭৯ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ২৬৩ জন, সুনামগঞ্জে ৫৬ জন, হবিগঞ্জে জেলার ৩০ জন ও মৌলভীবাজারে ৩০ জন।