সর্বোচ্চ শনাক্তের দিনে লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত

Slider জাতীয়


করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই জনসাধারণের সার্বিক চলাফেরার ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্‌যাপন উপলক্ষে আগামী ১৫ই জুলাই থেকে ২২শে জুলাই পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে। আজ এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার সোমবার সন্ধ্যায় এক তথ্যবিবরণীতে বিষয়টি গণমাধ্যকে জানিয়েছেন। তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, আগামী ২৩শে জুলাই থেকে আবার কঠোর বিধিনিষেধ জারি হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১৫ই জুলাই বৃহস্পতিবার থেকে ২২শে জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল করবে এবং শপিংমলগুলো খোলা যাবে। কোরবানির হাটও বসবে সারা দেশে। এই সময়ে সরকারি অফিস ভার্চ্যুয়ালি চলবে।

বন্ধ থাকবে সব ধরনের বেসরকারি অফিস। ওদিকে রেলওয়ে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে অর্ধেক আসন খালি রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেন চলাচল করবে। তবে টিকিট বিক্রি হবে শুধু অনলাইনে। মঙ্গলবার থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হবে।

লকডাউন শিথিলের দিনেই সর্বোচ্চ করোনা শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৩,৭৬৮ জন। মৃত্যু হয়েছে ২২০ জনের।
সূত্র জানায়, গত শনিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক সপ্তাহের জন্য বিধিনিষেধ শিথিলের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করে গণপরিবহন, দোকানপাট, শপিংমল চালু থাকবে। ট্রেন, লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু থাকবে মানুষ যেন নির্বিঘ্নে ঈদ উদ্‌যাপন করতে পারে সে বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। এ আলোচনার সারসংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। যদিও করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শকে আমলে নিলে বিধিনিষেধ শিথিলের সুযোগ নেই বলে মনে করছেন কেউ কেউ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১লা জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। প্রথমে ৭ই জুলাই পর্যন্ত তা থাকলেও পরে তা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়, যা আগামী ১৪ই জুলাই শেষ হবে। তবে বিধিনিষেধের মধ্যে সব সরকারি অফিসের দাপ্তরিক কাজগুলো ভার্চ্যুয়ালি (ই-নথি, ই-টেন্ডারিং, ই- মেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যম) সম্পন্ন করা হবে। শ্রমজীবী মানুষসহ জীবিকার দিক বিবেচনা করে ঈদের আগে বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ শিথিল করলে পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটা নিয়েও আশঙ্কা আছে।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি করুণ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রোববার দুপুরে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভার্চ্যুয়াল বুলেটিনে অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন এই আশঙ্কার কথা জানান। গত ২৪শে জুন জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সারা দেশে ১৪ দিনের শাটডাউনের সুপারিশ করা হয়। কমিটির সুপারিশের আলোকে ২৮শে জুন থেকে ৩০শে জুন তিনদিন সীমিত পরিসরে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর ১লা জুলাই থেকে দেশব্যাপী শুরু হয় কঠোর বিধিনিষেধ। যা পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৪ই জুলাই পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।

এদিকে করোনার সংক্রমণ ইস্যুতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, করোনা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছে। সেজন্য আমাদেরও সচেতন হতে হবে। সরকার পুলিশ দিয়ে কতো সচেতন করবে, যদি নিজেরা সচেতন না হই। সোমবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে সব সময় আহ্বান করে আসছি, যাতে জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। যতক্ষণ পারা যায় মাস্ক পরে থাকতে হবে। ঈদে গরু বেচাকেনার জন্য লকডাউন শিথিল হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এখানে অনেকগুলো কারণ আছে। যেমন খামারিরা যদি পশু বিক্রি করতে না পারে, তাহলে আরও একবছর পরিচর্যা করতে হবে। তারপর দোকান মালিক যারা আছেন, তারা কিন্তু ঈদের জন্যই সারা বছর বসে থাকে। দুই ঈদের বেচাকেনা দিয়েই তারা চলে। এসব কিছু বিবেচনা করেই সরকার জীবিকা ও জীবনের তাগিদে যেগুলো প্রয়োজন, সেগুলো মাথায় রেখেই যা কিছু করার নির্দেশনা দেবে। বিধিনিষেধ শিথিলের বিষয়ে পুলিশের প্রতি কী নির্দেশনা থাকবে- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় শুধু পুলিশ নয়, প্রশাসনের সবাই মাঠে কাজ করছে। মূল বিষয়টা হলো আমাদের যে সিদ্ধান্ত, তা জনগণকে জানিয়ে দেয়া ও সচেতন করা এবং জনগণ যাতে সেটা মেনে চলে সে ব্যবস্থা করা। আমাদের পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি সহ সবাই এক সঙ্গে কাজ করছে।
একদিনে রেকর্ড ১৩,৭৬৮ জন শনাক্ত, আরও ২২০ জনের মৃত্যু

দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে করোনা শনাক্তে নয়া রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে গতকাল। প্রায় প্রতিদিনই শনাক্তে অথবা মৃত্যুতে রেকর্ড হচ্ছে দেশে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তে আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে করোনায় নতুন করে ১৩ হাজার ৭৬৮ জন শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তে এ যাবৎকালে এটাই সর্বোচ্চ।

করোনার সংক্রমণে দেশ পিকটাইমে ঢুকেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। এর থেকে নামতে এক মাসের চেয়ে কম সময় লাগতে পারে। করোনার ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণে না এলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি করুণ হওয়ার লাল বার্তাও দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। একদিকে দেশে সর্বোচ্চ শনাক্তের দিনে সরকারের কঠোর লকডাউনের শিথিলতার ঘোষণা এলো। যা ১৫ই জুলাই থেকে ২২শে জুলাই পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

সংক্রমণের আমরা কোন অবস্থায় আছি জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ চলছে। এবার সংক্রমণ গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এই দফায় করোনা দাবানলের মতো সংক্রমিত হয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে করোনার সংক্রমণ প্রলম্বিত হয়। বর্তমানে সংক্রমণের পিকটাইম বা চূড়ায় রয়েছি আমরা। তিনি আরও জানান, সাধারণত সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশ হলেই তখন পিকটাইম বলা হয়। দেশে এখন প্রায় প্রতিদিনই করোনা শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপর। তাই আমাদের এখানে এখন সংক্রমণের পিকটাইম চলছে। এক মাসেরও কম সময় লাগতে পারে এই চূড়া থেকে নামতে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে একদিনে করোনায় নতুন করে ১৩ হাজার ৭৬৮ জন শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তে এ যাবৎকালে এটাই সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১১ই জুলাই দেশে ১১ হাজার ৮৭৪ জন শনাক্ত হয়েছিল। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ২২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৬ হাজার ৬৩৯ জনে। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭ হাজার ২০ জন এবং এখন পর্যন্ত ৮ লাখ ৮১ হাজার ৫২১ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ৬২৭টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ হাজার ৪৫টি নমুনা সংগ্রহ এবং ৪৪ হাজার ৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০ লাখ ১৫ হাজার ২৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং এ পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৫ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ২২০ জনের মধ্যে পুরুষ ১৪২ জন আর নারী ৭৮ জন। দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় মোট পুরুষ মারা গেছেন ১১ হাজার ৬৫০ জন এবং নারী ৪ হাজার ৯৮৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে বয়স বিবেচনায় ষাটোর্ধ্ব রয়েছেন ১২১ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৪৬ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২৬ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৭ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৯ জন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১ জন। মারা যাওয়া ২২০ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৬৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৭ জন, রাজশাহী বিভাগের ২৩ জন, খুলনা বিভাগের ৫৫ জন, বরিশাল বিভাগের ৪ জন, সিলেট বিভাগের ৬ জন, রংপুর বিভাগের ১৮ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগের আছেন ১৩ জন। এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন ১৬৭ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ৪০ জন এবং বাসায় ১৩ জন।

এদিকে বিভাগ ভিত্তিক শনাক্তের হার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের মোট শনাক্তের ৪৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ রোগী রয়েছেন ঢাকা বিভাগে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৪১৩ জন। এই বিভাগে শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৬ শতাংশ। আগের দিনের চেয়ে শনাক্তের হার ৫ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫০০ জন। শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ। চট্টগ্রামে বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৩১১ জন। শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ১০ শতাংশ। রাজশাহীতে শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৩৯ জন। শনাক্তের হার ২৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। রংপুর বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ৬১৩ জন। শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। খুলনা বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৬৪২ জন। শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ৫৭৫ জন। শনাক্তের হার ৪৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। একই সময়ে সিলেট বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩৭৫ জন। শনাক্তের হার ৩৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *