দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু দেড়শ’ থেকে দুইশ’র মধ্যে ওঠানামা করছে। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর দেশে প্রতিদিন যতো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে তার হিসাব মিলছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। তাদের নাম সরকারি তালিকায়ও থাকছে। এই সংখ্যা ছাড়াও আরও অনেকেই মারা যাচ্ছে উপসর্গ নিয়ে। করোনা শনাক্ত হওয়াদের চেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে উপসর্গ নিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপসর্গে মারা যাওয়ার সংখ্যাটাও বড়। শুধু এবারই নয়, এর আগে আরও দুই দফা দেশে যখন উচ্চমাত্রার সংক্রমণ হয়েছিল, তখনো উপসর্গে মৃত্যুর হিসাবটা এমনটাই ছিল বলে জানান করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার তথ্য পর্যবেক্ষণকারী গবেষকরা।
গত কয়েক দিনে দেশে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় প্রতিদিনই শনাক্ত হওয়া মৃত্যুর সঙ্গে বাড়ছে উপসর্গে মৃত্যুও। কোনো কোনো এলাকায় শনাক্ত- মৃত্যুর পাশাপাশি উপসর্গে মৃত্যুর তথ্যও মিলছে; যারা সবাই ওই হাসপাতালগুলোর করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে ভর্তি থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ দিনে (২৩শে জুন থেকে ৭ই জুলাই পর্যন্ত) হাসপাতালটিতে করোনায় এবং উপসর্গ নিয়ে মোট ২০২ জন মারা গেছেন।
এরমধ্যে করোনা পজেটিভ ছিলেন ৭৩ জন। বাকি ১২৯ জন উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে হাসপাতালটির পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্যমতে, ঢামেকে ৭ই জুলাই করোনায় মারা যান ৫ জন এবং উপসর্গে ৯ জন, ৬ই জুলাই করোনায় ৬ জন এবং উপসর্গে ১০ জন, ৫ই জলাই করোনায় ৭ জন এবং উপসর্গে ১১ জন, ৪ঠা জুলাই করোনায় ৬ জন এবং উপসর্গে ৯ জন, ৩রা জুলাই করোনায় ৩ জন এবং উপসর্গে ১৮ জন, ২রা জুলাই করোনায় ৪ জন এবং উপসর্গে ৬ জন, ১লা জুলাই করোনায় ৬ জন এবং উপসর্গে ৭ জন, ৩০শে জুন করোনায় ৪ জন এবং উপসর্গে ৫ জন, ২৯শে জুন করোনায় ৩ জন এবং উপসর্গে ৯ জন, ২৮শে জুন করোনায় ৬ জন এবং উপসর্গে ৫ জন, ২৭শে জুন করোনায় ৩ জন এবং উপসর্গে ৮ জন, ২৬শে জুন করোনায় ৭ জন এবং উপসর্গে ১২ জন, ২৫শে জুন করোনায় ৩ জন এবং ৬ জন উপসর্গে, ২৪শে জুন করোনায় ৬ জন এবং উপসর্গে ৬ জন এবং ২৩শে জুন করোনায় ৩ জন এবং উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৯ জন।
এদিকে রাজশাহী থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে করোনা পজেটিভ ছিলেন ৮ জন। বাকিদের মধ্যে ৯ জন শ্বাসকষ্টসহ করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান। আর একজন মারা যান করোনামুক্ত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এ নিয়ে গত ৭ দিনে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ১১৭ জন। যাদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত ছিলেন ৩৭ জন। করোনা উপসর্গ নিয়ে ৭৭ জন এবং করোনামুক্ত হওয়ার পর ৩ জন মারা গেছেন। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা পজেটিভ ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহীর ৯ জন, চাঁপাই নবাবগঞ্জের ২ জন, নাটোরে ২ জন, নওগাঁয় ৩ জন, পাবনায় ১ জন ও কুষ্টিয়ায় ১ জন। মৃতদের মধ্যে ১৪ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী। গত ৭ দিনে (২রা জুলাই থেকে ৮ই জুলাই সকাল পর্যন্ত) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ১১৭ জন। এরমধ্যে ৩৭ জন মারা গেছেন করোনা শনাক্ত হওয়ার পর। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা যান। কেউ কেউ করোনামুক্ত হয়ে মারা গেছেন। এরমধ্যে ২রা জুলাই ১২ জন, ৩রা জুলাই ৫ জন, ৪ঠা জুলাই ১ জন, ৫ই জুলাই ৫ জন, ৬ই জুলাই ৪ জন, ৭ই জুলাই ২ জন এবং সর্বশেষ ৮ই জুলাই ৮ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
খুলনা বিভাগে মৃত্যু কেন বেশি জানতে চাইলে খুলনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, করোনার রোগীরা সর্দি-কাশিকে পাত্তা দিচ্ছে না। গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার রোগী। তথ্য গোপন করে বাড়িতে থাকছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। আক্রান্তের শুরুতে হাসপাতালে আসতে চাচ্ছেন না। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলেই কেবল তখনই হাসপাতাল আসছেন। তখন তাদের বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি জানান, বেশির ভাগই ৫০ বছরের উপরের লোক মারা যাচ্ছেন। যারা আগে থেকে আরও কিছু জটিল রোগে ভুগছিলেন। এই অবস্থায় করোনার উপসর্গযুক্ত রোগীকে হাসপাতালে আসার অনুরোধ করেছেন সিভিল সার্জন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে (২৬শে জুন পর্যন্ত) দেখা যায়, দেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে মোট ২ হাজার ৪৫৩ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৯৪ জন পুরুষ এবং ৪৫৯ জন নারী। এ ক্ষেত্রে ওই দিন পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৪২ জন, খুলনা বিভাগে ৪৪৬ জন, ঢাকা বিভাগে ৩৯৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৬৪ জন, বরিশাল বিভাগে ২৪৪ জন, সিলেটে ১০২ জন, রংপুরে ৯৫ জন ও ময়মনসিংহে ৬৪ জন। এর মধ্যে জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি উপসর্গ নিয়ে ওই দিন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে কুমিল্লায়, সংখ্যাটা ২৫২। তবে শুধু রাজশাহী ও খুলনা জেলায় গত ৯ থেকে ২২শে জুন পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে ১৫০ জনের মৃত্যুর হয়েছে বলে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের তথ্যে জানা যায়।