করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনে স্থবির জীবনযাত্রা। অফিস-আদালত গণপরিবহন, দোকানপাট বন্ধ। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না মানুষ। পথে পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্ট। এ অবস্থায় সবচেয়ে কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে রাজধানীতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবকিছু হারিয়ে ছিন্নমূল মানুষেরা ছুটে আসেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজেন নগরের গড়ে উঠা বস্তিতে। তারা দিনমজুরির কাজ করে সংসার সাজায়।
দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এক ঘরে গাদাগাদি করে রাতযাপন করেন। কিন্তু মহামারি করোনায় ভালো নেই তারা। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে ঘরবন্দি জীবনযাপন করছে। কাজ বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছে দিন। গতবছরের লকডাউনে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও এইবার মিলছে না কারও দেখা। বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি সংস্থা থেকে বার বার তাদের নামের তালিকাভুক্ত করলেও শেষ পর্যন্ত আর কোনো খবর নেই কারও। নামের তালিকাতেই আটকে রয়েছে সাহায্য পাওয়ার আশা। এমন অসহনীয় জীবনযাপন না করে তারা নিজেদের পেটের ক্ষুধা মিটাতে চান। করোনায় দফায় দফায় লকডাউন বাড়ালেও তাদের পেটের ক্ষুধা দেখার মতো নেই কোনো সংশ্লিষ্ট মহল। গত বছরের লকডাউনে সরকারি, বেসরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি ত্রাণ কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল ব্যক্তি উদ্যোগও। কিন্তু চলমান মহামারিতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এনজিও সংস্থাগুলো গতবারের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। ব্যক্তি উদ্যোগও নেই চোখে পড়ার মতো। এমনকি গত বছর দুস্থদের মাঝে গাড়ি নিয়ে খাবার বিতরণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোও। এ বছর তাও দেখা যাচ্ছে না।
রোকেয়া বেগম। মুখে বয়সের অনেকটা ছাপ পড়েছে। তেজগাঁও রেললাইনের পাশে বস্তিতে থাকতেন। কিন্তু গত আট মাস আগে ভেঙে দিয়েছে বস্তির ঘরগুলো। তারপর থেকে রেললাইনের পাশে পলিথিনের ঝুপড়ি ঘরে থাকেন তিনি। রোকেয়া বেগম জানান, নয় বছর আগে বন্যায় সব হারিয়ে রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। স্বামী পাঁচ বছর আগে স্ট্রোক করে মারা যান। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। করোনার আগে বাসায় কাজ করলেও এখন নেই। চেয়ে-চিন্তে খেয়ে চলছে দিন। তিনি বলেন, লকডাউন শুরু হওয়ার পর টাকাও পাচ্ছি না। এখনো পর্যন্ত কারও কোনো সাহায্য পাইনি। শুধু শোনা যায় সাহায্য দিবে। কিন্তু তার কোনো খবর নেই। দেশ গ্রাম থেকে আসছি, পেটে খাবার দিতে। কিন্তু এখন প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। কাওরান বাজারে ট্রাকের কলা, সবজি কুড়িয়ে বিক্রি করতাম। এখন সব বন্ধ। সকাল হলেই কী খাবো সে চিন্তায় ঘুম আসে না।
দশ বছর আগে সিলেট থেকে এসেছেন শাহনাজ বেগম। থাকেন বেগুনবাড়ীর বস্তিতে। স্বামী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার। তিনি বলেন, কাওরান বাজার থেকে ভাঙা ডিম এনে বিক্রি করতাম। এখন রাস্তায় বসতে দেয় না। লকডাউনে সব বন্ধ। ঘরে খাবার নেই। মাস শেষে না খেয়ে থাকলেও ২৫০০ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। ছেলেমেয়েরা সারাদিন খাবারের জন্য কান্নাকাটি করে। সাহায্য দেয়ার কথা বলে অনেকবার ছবি, আইডি কার্ডও নিয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কারও কোনো সহায়তা পাইনি।
গোলাপি আক্তার বলেন, লোকজন এসে অনেক বার নাম নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের আর কোনো খবর নেই। সরকারের কেউ এখন পর্যন্ত আসেনি। বাইরে কোথাও কাজের জন্য যেতে পারছি না। কাজ করে আয় করতে পারলে খাবারের আর কোনো অভাব ছিল না।
তরিকুল ইসলাম বলেন, মাসে তিন হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। কাওরান বাজার ভ্যানে কাঁচামাল বহন করি। এখন ঘরবন্দি হয়ে আছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো মতে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি।
নাছিমা বেগম বলেন, সরকার শুধু গরিবদের জন্য দিবে দিবে করে কিছুই দেয় না। আমরা তো এখনো পর্যন্ত কিছুই পেলাম না। সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। একরুমেই পাঁচজন থাকি। না খেয়ে থাকলেও ঘর ভাড়া প্রতিমাসে দিতে হয়। সব কাজ বন্ধ। ইনকাম নেই কোনো। সারাদিন ছেলেমেয়েদের ক্ষুধার জন্য কান্নাকাটি শুনতে হয়। কাজ করতে পারলেও পেটে খাবার দেয়া যায়। এখন তো কাজই নেই।
সাফিয়া বেগম বলেন, অনেকে অভাবের কারণে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। ঘর ভাড়া দিতে পারে না। বাইরে রাস্তায় গিয়ে থাকে। রেলগেটের বস্তি থেকে অনেকে আসছিল। কেউ অভাবের জন্য থাকতে পারেনি। নিজেরা না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু ছোট বাচ্চাদের কীভাবে থামাবো। আমরা লকডাউন চাই না। নিজেরা ইনকাম করে খেতে চাই।
রুবেল হাসান বলেন, আমরা খাবার চাই না। লকডাউন খুলে দিক। আমরা ইনকাম করে খাবো। লকডাউন না খুলে দিলে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হউক ।
কোমেলা বেগম বলেন, ১০ বছর ধরে ঢাকায় থাকি- এরকম না খেয়ে মরতে হয়নি। পেটে ভাত নেই। আর করোনা দিয়ে কি করবো। কাওরান বাজারে কাজ করে খাইতাম। এখন দোকানপাট সব বন্ধ। না খেয়ে মরার অবস্থা হইছে। বস্তি ভেঙে দেয়ার পর টাকার অভাবে রাস্তায় পলিথিন দিয়ে কোনোমতে থাকি। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। ১০-১২ জায়গা থেকে সাহায্য করার জন্য নাম নিয়ে গেছে কয়েক মাস আগে। কিন্তু এখনো কিছুই দেয়নি। এই লকডাউনে তো এখনো পর্যন্ত কেউ আসেনি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়ে যায় কিন্তু কিছুই পাই না। এভাবে কাজ বন্ধ থাকলে ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫শে এপ্রিল থেকে খাদ্য সহায়তা চেয়ে ৩৩৩-নম্বরে কল এসেছে প্রায় ১৯ লাখ। জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে গত ১লা জুলাই থেকে ৬ই জুলাই পর্যন্ত সিটি করপোরেশনগুলোতে ৩৩৩- এর মাধ্যমে কোনো প্রকার খাদ্য সহায়তা যায়নি। গত ২৫শে এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া খাদ্য বিতরণ কার্যক্রমে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩ হাজার ২৭৪টি পরিবারের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। যেখানে জেলা পর্যায়ে খাদ্য সহায়তা পেয়েছে প্রায় ৬০ হাজারের মতো পরিবার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া বিধিনিষেধকে সামনে রেখে সিটি করপোরেশনগুলোতে নগদ ৫০ লাখ টাকা ও ১০০ টন করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর আগে প্রতিটি সিটি করপোরেশনে এক কোটি ৭ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়ররা নানা কাজে ব্যস্ত। ত্রাণ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার বিষয়ে বুধবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছেন।