দেশে হঠাৎ করে করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন করে বেড়েছে বাসায় থাকা রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা। সংক্রমিত ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর বুঝে ওঠার আগেই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছেন। তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হলে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন কেউ কেউ। আবার সাধারণ অসুখ মনে করে বাসায় বসেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। জেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে.আইসিইউ এবং অক্সিজেন সরবরাহ থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় বাড়িতে মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন মাসে ১৩০ জন করোনার তীব্র উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে ও হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা গেছেন। এছাড়া গত ছয় মাসে সারা দেশে ২৬৮ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর বাসায় মৃত্যু হয়। এছাড়া ১৭ জনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে নেওয়ার পথে। এবং গত মে মাসের তুলনায় জুনে এসে বাড়িতে মৃত রোগী বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি।
মে মাসে ৪৭ জনের মৃত্যু হয় বাড়িতে। জুনে বাড়িতে ১২৪ জন মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় আরও ৬ জনের। গত জানুয়ারিতে ১২ জন, ফেব্রুয়ারিতে সাতজন ও মার্চে নয়জন আক্রান্ত রোগী বাড়িতে মারা যান। এপ্রিলে সংক্রমণ কিছুটা বাড়ায় বাড়িতে ৬৯ জন ও হাসপাতালে নেয়ার পথে ১১ জনের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজির আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এটা অবধারিত। ২০২০ সালে দেশের বড় বড় শহর বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন বিভাগে সংক্রমণ হয়েছে। এ সকল শহরের মানুষজনের ব্যক্তিগত সচ্ছলতা রয়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি। এবং তাদের হাসপাতালে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো। অসুস্থ হলেই সঙ্গে সঙ্গে হাসপতালে গিয়ে ভর্তি হতেন। সুতরাং তারা চিকিৎসা সেবা পাওয়ার পাশাপাশি তাদের মৃত্যুটা হাসপাতালেই হয়েছে। কিন্তু এবারের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে গ্রামে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষজন অবস্থাসম্পন্ন নন। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। তাছাড়া গ্রামের হাসপাতালগুলোতে পিসিআর ল্যাব নেই। এক্ষেত্রে গ্রামের কোনো ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হলে শনাক্ত হবে কীভাবে? তাছাড়া অধিকাংশ জেলা হাসপাতাগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই সীমিত। চিকিৎসক সংকট রয়েছেই। তাহলে চিকিৎসাসেবা পাওয়া কীভাবে সম্ভব? তিনি বলেন, জেলা হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ব্যবস্থা আছে কি না আমাদের জানা নেই। ভেন্টিলেটর নেই সবখানে।
অনেকের আবার আর্থিক সঙ্গতি নেই। অনেকেই বুঝতে পারেন না করোনা হয়েছে। হঠাৎ করে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ডায়রিয়া হয়েছে অথবা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত, জেলা হাসপাতালগুলোতে অনেক রোগীকে করোনা চিকিৎসা দেয়ার পরে মনে হয় রোগী সুস্থ্য আছেন। ফলে হাসপাতালে বেডের সংখ্যা কম থাকায় তাদের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। অথবা তারা বাসায় চলে যাচ্ছেন। বাড়িতে গিয়ে ওই রোগী মারা যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে যে মৃত্যুর সংখ্যাটা আমরা দেখছি তার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি।
এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা না পেলে তারাতো বাসা-বাড়িতে মারা যাবেন। একজন ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরে হাসপাতালে সিট পাচ্ছেন না। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে চিকিৎসা না পেয়ে পথেই মারা যাচ্ছেন। অথবা বাড়িতে মারা যাচ্ছেন। অতএব রাস্তায় মারা যাওয়ার চেয়ে বাড়িতে মৃত্যুই ভালো। তিনি বলেন, সঠিক চিকিৎসা না পেয়েই আক্রান্ত ব্যক্তি বাসায় মারা যাচ্ছেন। এটা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সরকারের দুর্বলতা। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ না কমিয়ে লকডাউনের নামে যানবাহন বন্ধ করলে কি সংক্রমণ কমবে? এটা অনেকটা মশা মারতে লাঠি নিয়ে বের হওয়ার মতো। প্রথমত, সংক্রমণ কমাতে মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এ ধরনের মৃত্যু আরও বাড়তে থাকবে