ওয়াছিউর রহমান খসরু। জীবনের প্রয়োজনে স্বপ্নের বলি দেয়া এক যুবক। কিন্তু স্বপ্নের মৃত্যু হলেও জীবন চলছে এখন উচ্চ গতিতে। সামনে নেই কোনো বাধা। ফেনীর ছেলে খসরু কীভাবে তার স্বপ্নকে বলি দিয়ে জীবনকে টেনে নিচ্ছেন? এ যেন এক ইতিহাস। ওয়াছিউর রহমান খসরু সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পড়তে এসেছিলেন। ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায় তার বাড়ি। ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও
মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন যে তার পূরণ করতে হবে। তাই ফের স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় মাস্টার্সে ভর্তি হন। মাস্টার্স পড়ার সময় একটি অনলাইন পোর্টালে সাংবাদিকতা শুরু তার। কয়েক বছর সাংবাদিকতা করেন। এরপর যোগ দেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অফিসার হিসেবে। কিন্তু তার মন যে পড়ে আছে সাংবাদিকতায়। এ টানে আবার ফিরেন সাংবদিকতায়। সাংবাদিকতা করে মাসে দশ হাজার টাকা বেতন পেতেন। এই টাকায় মেসে থেকে বাড়িতে টাকা পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তার বাবা মারা যান। মা বাড়িতে একা। ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। মা’কে ঢাকায় এনে বাড়ি ভাড়া করে রাখাও সম্ভব নয়, এত অল্প বেতনে। নিজের জীবনে যখন এমন টানাপোড়েন চলছিল তখন কি করবেন খসরু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে সাংবাদিকতা যে আর করা হবে না সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাহলে কি জীবনের প্রয়োজনে স্বপ্নের বলি দিতে হবে? এমন জীবিকা বেঁছে নিতে হবে যেখানে জীবন হবে নিরাপদ। বাবার রেখে যাওয়া পাঁচ লাখ টাকাই তার সম্বল। এত স্বল্প পুঁজি দিয়ে তো ঢাকায় ব্যবসা করা সম্ভব না। তখন তার মেসের এক রুমমেট পরামর্শ দিলেন খামার গড়ে তোলার। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ঢাকা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে সোনাগাজী ফিরে যান খসরু। পারিবারিক অনাবাদি জমির ওপর শুরু করেন খামার তৈরির কাজ। সঠিক পরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে এখন একজন সফল আত্মকর্মী খসরু। গড়ে তুলেছেন রহমান এগ্রো ফার্ম।
খসরু বলেন, গ্রামে এসে স্বল্প পুঁজি নিয়ে সমন্বিত কৃষি ব্যবসার শুরুর গল্পটা মোটেই ভালো ছিল না। নানান তিক্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শুরু হয় কঠিন পথচলা। শুরুতে সোনালী মোরগের একটি শেড নিয়ে ব্যবসা শুরু। পরের বছর মাছ, তারপরের বছর গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প। পাশাপাশি বারোমাসি ফল ও সবজি উৎপাদন। স্থানীয় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও সার্বিক সহায়তায় চলে প্রকল্পের কার্যক্রম। সফল এই উদ্যোক্তা বলেন, সমন্বিত এই কৃষি প্রকল্পের প্রাথমিক মূলধন ছিল অতিসামান্য। কিন্তু আমার মনোবল ছিল দৃঢ়। পরিবারের অল্প সঞ্চয় ও বন্ধুদের আর্থিক সহায়তা নিয়ে শুরু। দুই একর জমি নিয়ে শুরু করা প্রকল্প এখন আট একর জমির ওপর দাঁড়িয়েছে। এই ফার্মে এখন ১২ জন স্থায়ী কর্মচারী। প্রকল্প এলাকায় দুটো সোনালী মোরগের শেডে ছয় হাজার মোরগ, পাঁচটি পুকুরে মিশ্র কার্প ও তেলাপিয়া চাষ এবং দেশি জাতের ষাঁড় গরুর মোটাতাজাকরণ প্রকল্প চলমান। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন জাতের বারোমাসি ফলজ গাছ ও সবজি চাষ। সঠিক পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও সততা থাকলে সফল হওয়া সহজ। আমি সবসময় কাজকে প্রধান্য দিয়ে সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতাম। এই বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ এগিয়ে নিতাম। পণ্যের গুণগত মানের ক্ষেত্রে ব্যবসা নয়, সেবাকে প্রাধান্য দিয়ে উৎপাদন করতাম। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি অন্য উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমার সফলতার জন্য আমি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, আমার সহকারী ও কর্মচারীর নিকট কৃতজ্ঞ। ওয়াছিউর রহমান খসরু সফল উদ্যোক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পুরস্কার-২০২০ এ ভূষিত হন। সামাজিক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২০ সালের ১লা নভেম্বর জাতীয় যুব দিবসে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে জাতীয় পর্যায়ে সফল আত্মকর্মী হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পুরস্কার লাভ করেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ আত্মকর্মী হিসেবে পুরস্কার পান।