রাজধানীর মিরপুরে সেনা তৎপরতা ছবি: জীবন আহমেদহঠাৎ বদলে গেল দৃশ্যপট। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর চিত্র অনেকটা অচেনা। গিজ গিজ করা সড়কে হঠাৎ মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। যানবাহনও নেহায়েত কম। জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষ কর্মস্থলে যাচ্ছেন রিকশা বা অন্য কোনো যানবাহনে করে। মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনা-বিজিবির টহল। কোথাও কোথাও মোবাইল কোর্টের তল্লাশি।
সারা দেশে কঠোর লকডাউন শুরুর প্রথম দিন এমন চিত্রই দেখা গেছে রাজধানীতে।
সারা দেশে একইভাবে সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ কারণে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল আগের দিন থেকে অনেক কম। লকডাউনের কারণে সব ধরনের যানবাহন ছিল বন্ধ। দোকান, বিপণিবিতান বন্ধ থাকায় কেনাকাটার জন্য মানুষ ঘর থেকে বের হননি। তবে কাঁচাবাজারে দেখা গেছে মানুষের জটলা। কড়াকড়ির মধ্যেও রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষ বিনা কারণে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাদের কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। শুধু রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৫০ ব্যক্তিকে। ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, আটকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইনে মামলা দায়ের করা হয়। আরো অনেককে মুচলেকা বা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়।
মানুষকে বিনা প্রয়োজনে বাইরে না আসতে সতর্ক করে বিভিন্নস্থানে টহল দিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
সরকারি ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, পণ্যবাহী বাহন ছাড়া কিছু রিকশা-ভ্যান চলেছে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে। যারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন তারা পড়েছেন পুলিশের জেরার মুখে।
গতকাল অফিস-আদালত, গণপরিবহন ও শপিংমল বন্ধ ছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ১০৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে দায়িত্ব পালন করেন। তবে মূল সড়কের মানুষের দেখা কম মিললেও সড়কের পাশের অলিগলিতে লোকজনের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে। অনেক স্থানে পুলিশ তাদের তাড়া করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। কেউ আবার লকডাউনের পরিবেশ দেখতে বাইরে বেরিয়েছেন। কোনো দোকানি তার দোকানের অর্ধেক শাটার ফেলে দোকান খোলা রেখেছেন। এছাড়াও একাধিক হোটেলে লোকজনকে একসঙ্গে বসে খেতে দেখা গেছে। সড়কে গাড়ি কম চললেও যে যার মতো ব্যক্তিগত কাজে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে গেছেন।
শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক অনুমোদিত যানবাহনগুলো ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। যারা বিভিন্ন জরুরি কাজে ঢাকায় এসেছেন তাদের ঢাকার প্রবেশপথে গাড়ি থেকে নেমে রিকশা বা ভ্যানে করে গন্তব্যস্থলে যেতে দেখা গেছে। ওদিকে ভোগান্তিতে পড়েছেন পোশাক শ্রমিক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সড়কে কোনো যানবাহন না থাকায় তারা বাড়তি ভাড়া দিয়ে রিকশা বা ভ্যানে গন্তব্যে পৌঁছেন। কিছু প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করতে দেখে বিভিন্ন স্থানে যাওয়া ব্যক্তিরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এছাড়াও গতকালও যে যার মতো পেরেছেন ঢাকা ছেড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে চলে গেছেন। ঢাকার গাবতলী ব্রিজ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিল মানুষের ভিড়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) মো. শফিকুল ইসলাম গতকাল মানবজমিনকে জানান, সড়কের মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। বিধিনিষেধ ভঙ্গ করলে তাকে জরিমানা করা হচ্ছে।
গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর গাবতলী, ফার্মগেট, সেগুনবাগিচা, পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ, মালিবাগ ও কাকরাইল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যেক এলাকায় কড়া নজরদারি রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সড়কের মোড়ে মোড়ে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল দল।
তবে কাঁচাবাজারে সেই আগের চিত্রই দেখা গেছে। কল্যাণপুর কাঁচাবাজারে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। উন্মুক্তভাবে কাঁচাবাজার বসানোর কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। সেখানে মানুষজনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই ছিল না। অনেকের মুখে মাস্কও ছিল না। কাঁচামাল ব্যবসায়ী রতন জানান, পুলিশ বাজারে আসেনি। ঢাকার কাওরান বাজার, মহাখালী ও সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারেও একই চিত্র দেখা যায়।
রিকশাচালক হাবিবুর রহমান জানান, সকালে রিকশা নিয়ে সড়কে নেমেছে। মূল সড়কে পুলিশ অন্য দিনগুলোতে বাধা দিয়ে থাকে। তবে লকডাউনের প্রথম দিন পুলিশ তাদের কোনো বাধা দেয়নি। সকালে যাত্রীর চাহিদা বেশি ছিল। বেশি ভাড়া হাঁকা হয়েছে। তিনি ভাড়াও পেয়েছেন বলে জানান।
ট্রাফিক পুলিশ আবির হোসেন জানান, লকডাউনে যানবাহনের চাপ নেই। তবে প্রাইভেট গাড়িগুলো থামিয়ে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তাদের পরিচয় ও লকডাউনে কেন তারা বের হয়েছেন।
গতকাল শাহবাগ মোড়ে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ একটি সাদা প্রাইভেট কার থামিয়েছে। ঢামেকের চিকিৎসক পরিচয় দেয়ার পর ওই গাড়িকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
গ্রেপ্তার ৫৫০: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যে ‘জরুরি প্রয়োজন ছাড়া’ রাস্তায় বের হয়ে রাজধানীতে পুলিশের হাতে আটক হতে হয়েছে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেল মোট ৫৫০ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায়। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা নাগাদ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অপ্রয়োজনে বের হওয়া গাড়ির বিরুদ্ধে ২৭৪টি মামলা হয়। জরিমানা আদায় করা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগেই ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় অপ্রয়োজনে বের হওয়ার কারণে। এরমধ্যে তেজগাঁও এলাকায় ৩০ জন, শিল্পাঞ্চল থানায় ৮ জন, মোহাম্মদপুরে ২৬ জন, আদাবর থানায় ১৮ জন, শেরেবাংলা নগর থানায় ৪০ জন এবং হাতিরঝিল থানায় পুলিশ ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করে। লালবাগে ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই বিভাগে ২৫টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং ২৫ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। মতিঝিলে ১৯টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে ৪৫ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৯টি দোকানকে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। দুই ব্যক্তিকে মোট ১ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগে ১৫টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলায় ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অপ্রয়োজনে বের হওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। এছাড়া ১৬ জনকে মোট ১ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করা হয়। গুলশান বিভাগে ২১টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলায় ৬১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আটক করা হয় ৭ জনকে এবং ৮ জনকে সাজা দেয়া হয়।