দেশে গত বছর করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষয়ক্ষতি এখনো সামলে উঠতে পারেননি সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে এ বছরও মহামারীর নতুন ঢেউ তাদের আরও অসহায় করে তুলেছে। তার ওপর সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী ৭ দিনের জন্য সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে আয় রোজগার নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষরা। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে এখন যেন চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের দংশন থেকে বাঁচাতে নিম্নআয়ের মানুষকে বাঘের মুখে ফেললে হবে না। করোনা থেকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের ক্ষুধায় মেরে ফেলা যাবে না। এ জন্য চাই করোনা মোকাবিলা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারি বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যবহার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য এ সময়ে চলা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারের পক্ষেও সবার জন্য খাদ্যের জোগান দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়েছে বলে কারও জানা নেই। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন কার্যকর করতে হলে দিনমজুর, বাসের হেলপার, হকারসহ খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য সরকারকে সহায়তা দিতে হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের কোথাও কোথাও যেখানে করোনার সংক্রমণের হার অনেক বেড়েছে, সেখানে কঠিন লকডাউনের বিকল্প নেই। তা ছাড়া দেশের সবাইকে এখনো টিকার আওতায় আনা যায়নি। সুতরাং ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কড়াকাড়ি বিধিনিষেধ আরোপ কিংবা লকডাউনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পরিকল্পনাও থাকতে হবে। লকডাউনের আগে নিম্নআয়ের মানুষ ও দরিদ্রদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা। এ ছাড়া তাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না। তাতে মিলবে লকডাউনের কাক্সিক্ষত ফলাফল। একূল-ওকূল দুটিই হারাতে হবে। একদিকে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে সংক্রমণ হারও কমবে না।
তিনি আরও বলেন, লকডাউনে কাজ বন্ধ, এমনকি নিম্নআয়ের মানুষ গ্রামেও ফিরে যেতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্ররা বেঁচে থাকবে কীভাবে? এ সময় এই মানুষদের কাছে অবশ্যই ত্রাণ কিংবা খাবার পৌঁছে দিয়ে বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা করে দিতে হবে। আমার কাছে অবাক লেগেছে যে, এ রকম একটা কঠিন কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম কোনো পরিকল্পনা কেন নেওয়া হয়নি। এমন নয় যে অর্থায়ন নেই। অর্থায়ন রয়েছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুরু হওয়া ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ রাজধানীর রাজপথ ছিল অনেকটাই ফাঁকা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে রাস্তায় থাকতে দেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে অনেকেরই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী শহীদ ফরুক সড়কে ফুটপাতে বাচ্চাদের কাপড়ের ব্যবসা করেন নুর মোহাম্মদ। বিধিনিষেধে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংসারের খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। নুর বলেন, একদিন দোকান বন্ধ থাকলে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়। এমনিতেই করেনায় পুঁজি শেষ, ঋণ করে চলছি। এখন দিনের ইনকামের টাকাতেই চলে আমার। লকডাউনে আবার বন্ধ সবকিছু। আগামী সাত দিন আমার সংসারের বাজার খরচের টাকাটাও নেই। পরিচিতদের কাছে ধার চেয়েও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
একই বিপদে রয়েছেন মাতুয়াইল সাদ্দাম মার্কেটের সেলুন ব্যবসায়ী মো. লিটন মিয়া। মায়ের দোয়া নামের ছোট্ট সেলুনেই চলে লিটনের সাত জনের সংসার। দুই ছেলে, তিন মেয়ের মুখে তিন বেলা খাবার কীভাবে তুলে দেবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় লিটন। তিনি বলেন, গত বছর অনেক টাকা দেনা হয়েছি। এখনো পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি দেনা আছি। প্রতিদিন সেলুন থেকে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা রোজগার হয়। তা দিয়েই বাজার, বাসা ভাড়া দিতে হয় আমার। এখন দোকান বন্ধ, কী করব বুঝে পাই না। আবার হয়তো ধার করতে হবে।
একই এলাকায় ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন মো. সালমান হোসেন। আগে মাস হিসাবে বেতন পেলেও করোনায় বেতন পান দিন হিসাবে। সালমান বলেন, একদিন কাজ বন্ধ থাকলে আমার আয়ও বন্ধ। বাড়ি টাকা পাঠাতে পারি না। এবার লকডাউনে ভেবেছিলাম বাড়ি চলে যাব। কিন্তু হাতের কাজ শেষ করে যেতে পারিনি।
সম্প্রতি ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, করোনায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বল্প আয় ও অনানুষ্ঠানিক খাতে সম্পৃক্তরা চাকরি ও উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। ৭৭ শতাংশ পরিবারের করোনার কারণে গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩৪ শতাংশ পরিবারের কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন। এই সময়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পরিবারগুলো সঞ্চয় ও ধারদেনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের গড় মাসিক সঞ্চয় ৬২ ভাগ কমে গেছে, ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। আরেক জরিপে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ জানিয়েছে, করোনা সংকটের সময় প্রান্তিক শ্রেণির ৮০ শতাংশ পরিবার খাবার কিনতে খরচ কমিয়েছে এবং প্রায় ৭৯ শতাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনো মহামারীর আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষরা। ভাইরাসের আতঙ্ক থাকলেও সমাজের এই বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য কাজের তাগিদটাই বেশি। ঘরে না থাকলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুঝুঁকি যেমন আছে, আবার জীবিকা নির্বাহ করতে না পারলে অনাহারের চোখ রাঙানিও রয়েছে। তাই খেটে খাওয়া মানুষের কপালে নতুন করে চিন্তার রেখা এঁকেছে লকডাউনের বিধিনিষেধ।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দরিদ্রদের খুব বেশি চাহিদা নেই। তিন বেলা খাবারের সন্ধানেই তাদের কাজ করতে হয়। এখন কঠিন লকডাউনে স্বাভাবিকভাবেই অনেকে কর্মহীন। তাই ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অন্তত খাবারের ব্যবস্থাটা করতে হবে। সাপের দংশন থেকে বাঁচাতে তাদের বাঘের মুখে ফেললে হবে না। করোনা থেকে বাঁচাতে গিয়ে ক্ষুধায় মেরে ফেলা যাবে না। এ জন্য করোনা মোকাবিলা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, করোনা প্রতিরোধের কার্যক্রম বাস্তবায়নে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। সেটি অনুযায়ী প্রত্যেকটি অঞ্চলে প্রান্তিক, দরিদ্র ও ভাসমান মানুষদের অন্তত খাবারের চাহিদা মেটাতে হবে। পাশাপাশি কোনো অজুহাতেই কোনো খাতকে লকডাউনে খোলা রাখা যাবে না। এগুলো করা গেলে দুই সপ্তাহের একটি লকডাউনে সংক্রমণ অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারব আমরা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের বিকল্প নেই। তবে নিম্নআয় ও খেটে খাওয়া মানুষসহ অসহায়দের খাবার নিশ্চিত না করে একের পর এক বিধিনিষেধ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারেও জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। এর মধ্যে নিম্নআয়ের মানুষ ও দরিদ্ররা কীভাবে জীবনধারন করবে? এর চেয়ে অমানবিকতা, নির্মমতা আর কী হতে পারে? সরকারকে এ বিষয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। তা ছাড়া লকডাউন দিলে পুরোপুরি কার্যকর করতে হবে। নইলে লকডাউনের উদ্দেশ্য অর্জন হবে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোথাও খোলা কোথাও বন্ধ রেখে বৈষম্য সৃষ্টি করা হলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে হতাশা কাজ করে।