করোনা সংক্রমণ ফের ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপের দিকে যাচ্ছে, যা সারা দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণের বিস্তৃতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। একদিনে শনাক্তের হার প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ পৌঁছেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আরও ৩ হাজার ৮৪০ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের ভিড় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনেক হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি।
শয্যা সংকটে চিকিৎসা ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে। এসব হাসপাতালে সেবা না পেয়ে ঢাকায় ছুটছেন করোনা রোগীরা। ঢাকাতেও ক্রমশ বাড়ছে সংক্রমণ। ঢাকা জেলায় গত দু’দিনে দ্বিগুণ হারে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। এতে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই বেড়েছে। গত ৩রা জুন ৩৬টি জেলাকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই সংখ্যাটি বেড়ে ৫০-এ পৌঁছেছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুসারে, শনাক্তের হার ১০ শতাংশ বা তার ওপরে হলে সেই জেলাকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে মৃত্যু ও শনাক্ত বিবেচনায় খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এজন্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা সংক্রমণ সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এখন ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। এদিকে করোনার থাবা মারাত্মক রূপ নিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা তেমন দেখা যাচ্ছে না। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না তারা। অলিগলি সর্বত্রই মানুষের জটলা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের উদ্যোগও তেমন চোখে পড়ছে না। সবকিছু এমন ঢিলেঢালা চললে ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড সংকট মোকাবিলায় সরকারি ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল এবং সরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সংকটকে আরও গভীর করেছে। ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞরা ক্লাস্টার ভিত্তিক বিধি-নিষেধ বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যথায়, দেশের অন্য জেলাগুলোতে খুলনা ও রাজশাহীর মতো পরিস্থিতি হতে পারে। জনস্বাস্থ্যবিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, ঢাকার বাইরে যেভাবে সংক্রমণ বেড়েছিল ঠিক একইভাবে ঢাকায়ও সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছি। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। আমি আশঙ্কা করছি যে আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ঢাকা শহরে ভাইরাসের সংক্রমণ খুলনা বা রাজশাহীর মতোই খারাপ হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম দেশে জুলাইয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। এখন সংক্রমণের গতি দেখে মনে হচ্ছে জুলাইতে যাওয়ার আগেই তৃতীয় ঢেউ ঘটে যাবে। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, কোভিড পরীক্ষা বাড়ানো ও সংক্রমিত ব্যক্তিদের অন্যদের থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে হয়। সবাইকে সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে। তাহলে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার মতো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভাব হবে। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, কোভিডের ডেলটা ভ্যারিয়েন্টটি ইতিমধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এখন তেমনভাবে মনোনিবেশ করা হয় না। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট অন্য কোনো ধরনের চেয়ে বেশি সংক্রামক। আমরা এখন যা দেখছি, বাস্তব পরিস্থিতি তার থেকেও ভয়াবহ। কারণ, নমুনা পরীক্ষা খুব কম হওয়ায় বেশির ভাগ রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের মতো খারাপ হতে পারে। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই উল্লেখ করে কোভিড শনাক্তের হার ১৫ শতাংশ বা তারও বেশি এমন এলাকায় লকডাউন কার্যকর করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য মতে, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩ হাজার ৩৪৫ জনে। একই সময়ে আরও ৩ হাজার ৮৪০ জনের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ১২ হাজার ৫৬২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩২৮ জন। এরমধ্যে ঢাকা মহানগরসহ ঢাকা জেলায় শনাক্ত হয়েছেন ৯১৬ জন। ঢাকা জেলায় আগের দিন শনাক্ত হয়েছিলেন ১ হাজার ১৩৫ জন। ১৫ই জুন এই সংখ্যা ছিল ৫৫০ জন। রাজশাহী বিভাগে ৪ হাজার ২৯০টি নমুনা পরীক্ষা হয়। এরমধ্যে শনাক্ত হয়েছে ৬৪৫ জন। খুলনা বিভাগে ২ হাজার ৭৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৭৬৫ জন শনাক্ত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৯৩৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৬৬ জন করোনা রোগী শনাক্ত। ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৩১টি নমুনা পরীক্ষায় ১০২ জন শনাক্ত। রংপুর বিভাগে ১ হাজার ২৫০টি নমুমা পরীক্ষায় শনাক্ত হন ৩৯৬ জন। বরিশাল বিভাগে ৩৪০টি নমুনা পরীক্ষায় ৫০ জন শনাক্ত হন এবং সিলেট বিভাগে ৫৮৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৮৮ জন করোনা রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।