অল্প পুঁজি নিয়ে ২০০৫ সালে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছিলেন শাহাদাত হোসেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। প্রকাশনা শিল্পে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবেই তাকে জানেন অনেকে। রাজধানীর বাংলাবাজারে অবস্থিত অন্বেষা প্রকাশন তারই হাতে গড়া। প্রতিবছর বই মেলাসহ বিভিন্ন ইভেন্টকে কেন্দ্র করে তার বার্ষিক আয় হতো ৪০-৫০ লাখ টাকা। বছরজুড়েই বাংলাবাজার স্টলে সাহিত্য, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস সহ সব ধরনের বইয়ের ছিল জমজমাট ব্যবসা। কিন্তু করোনা মহামারি সবকিছু বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এখন আর আগের মতো নেই বিকিকিনি।
আয় তো দূরের কথা, সংকটে পড়ে ব্যবসার পুঁজিও শেষ হয়ে যাচ্ছে। মহামারির ধাক্কায় প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। শুধু শাহাদাত নন, করোনার ধাক্কায় এমন অনেকেরই পথে বসার মতো উপক্রম হয়েছে। এক সময় যারা পরিবার নিয়ে সচ্ছল জীবন কাটাতেন, করোনা সেই সচ্ছলতা ভেঙে তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা কিংবা ভালো বেতনের চাকরি হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে হতাশায় দিন কাটছে তাদের।
চোখেমুখে হতাশার ছাপ নিয়ে মানবজমিনকে শাহাদাত হোসেন জানান, প্রকাশনা ব্যবসায়ীদের মূলত প্রতিবছর বইমেলাকে কেন্দ্র করেই ব্যবসার বড় টার্গেট থাকে। এরপর সেখান থেকে সারা দেশের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বইগুলো পৌঁছে দেয়া হয়। কিন্তু করোনায় বইমেলা কার্যত বন্ধ থাকায় সেভাবে আর ব্যবসা হচ্ছে না। তিনি বলেন, করোনার শুরুতে একদিকে বইমেলা বন্ধ হলো, অন্যদিকে সারা দেশের লাইব্রেরিগুলোও খুলতে পারছিল না। তখন ব্যবসা আমাদের একদম থেমে যায়। এখন লাইব্রেরি খুললেও বিক্রি নেই। যারা বই কিনেন তারা সাধারণত স্টলে আসেন, বই পড়ে নেড়েচেড়ে দেখেন তারপর বই কিনেন। কিন্তু করোনার মধ্যে সেই সুযোগটা নেই। মানুষ আর স্টলে আসে না।
তিনি বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে একবার আমরা বইমেলা পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু করোনা শুরু হলে সারা দেশের লাইব্রেরিতে যেসব বই দিয়েছিলাম সেগুলোর টাকা আর আমরা পাইনি। কারণ তার কিছুদিন পরেই পুরোপুরি লকডাউন শুরু হয়। তখন বড় একটা ধাক্কা খেলাম। এ বছর বইমেলা শুরু হলো এরমধ্যেই করোনার প্রকোপ বাড়লো। এ অবস্থায় বইমেলা থেকে কোনো আয় তো হয়নি, বরং বিশাল ক্ষতির মুখে পড়লাম। তখন পুঁজি ভেঙে কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে। এরমধ্যেই কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু এখন কোনো বেচাবিক্রি নেই। লস হতে হতে এখন পুঁজি শেষ। তিনি বলেন, যেখানে আমি লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করেছি। এখন সেখানে আমার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যবসার পুঁজি ভেঙে খেয়ে ফেলছি। পরিবার নিয়ে হতাশার মধ্যে দিন কাটছে আমার। এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। এভাবে আর কিছুদিন চললে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। আমি প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছি। এভাবে কোনো ব্যবসা করা যায় না। শাহাদাত বলেন, জীবনে এমন একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে কখনো ভাবিনি। আমার ৮-১০ জন স্টাফ কাজ করতো, গোডাউন ভাড়া, সবমিলিয়ে একটা ব্যবসা পরিচালনা করতে যে পরিমাণ ব্যয় করতে হয় সেটাই আমার আর অবশিষ্ট নেই। এখনো যদি করোনা ভালো হয়ে যায়, তবুও আমাকে নতুন করে ইনভেস্ট করতে হবে। আর সেটা পাবোই বা কি করে? সবমিলিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। এ অবস্থায় সরকার থেকেও কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছি না। ব্যাংক থেকে ঋণও দিচ্ছে না।
হবিগঞ্জের বাসিন্দা মালয়েশিয়া প্রবাসী আজাদ মিয়া। সেদেশে তিনি বাংলাদেশের টাকায় মাসে ৫৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। প্রথমে দুবাই এরপর মালয়েশিয়াতেই কেটেছে ৫ বছর। পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল তার জীবন। ১৮ মাস আগে ছুটিতে দেশে আসেন আজাদ। তখন সঞ্চয় করা টাকায় বাড়িতে নতুন ঘরের কাজ শুরু করেন। এমন সময় শুরু হয় করোনার প্রকোপ। পরে দুই মাসের ছুটিতে দেশে আসলেও করোনার কারণে আর ফেরা হয়নি। একদিকে ঘরের কাজও বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে জমানো টাকাগুলোও একেএকে খরচ করে ফেলেন। এ অবস্থায় পরিবারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। কিছুদিন প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চললেও এখন সেই ঋণের টাকাই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে কিছুদিন আগে স্ত্রীর সন্তান ডেলিভারির সময় হয়ে যায়। এর আগে গর্ভে থাকাকালীন জটিলতা দেখা দেয়। কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় স্ত্রীর গর্ভের সন্তানটি মারা যায়। প্রবাসে ৫৭ হাজার টাকা মাসে আয় করা এই ব্যক্তি এখন নিঃস্ব। বেঁচে থাকার স্বার্থে বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্য চাইছেন তিনি। গ্রাম থেকে শহরে একটা কাজের খোঁজে ছুটে চলেছেন। কিন্তু এখনো কোনো কাজ কিংবা কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পাননি।
তিনি বলেন, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে স্ত্রীর গর্ভের সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি। খুবই অসহায় লাগে এসব ভেবে। এক সময় কতো ভালো চলতাম। প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা ইনকাম করতাম। জমানো টাকা দিয়েই ঘরের কাজ শুরু করেছিলাম। এখন ঘরের কাজও শেষ করতে পারিনি। অর্থের অভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। পরিবারে আমার মা, স্ত্রী ও সন্তানসহ ৬ জন সদস্য। সবার দায়িত্ব আমার ওপরে। দুই মাসের ছুটিতে দেশে গত ১৮ মাস ধরে বাড়িতে বসা। অনেক চেষ্টা করেছি আবার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য। করোনার কারণে একাধিকবার টিকিট বাতিল হয়েছে। অনেক টাকাও শেষ করেছি। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। ধারদেনা করে আর কতোদিন চলা যায়? পরে এক জায়গা থেকে আরও ১ লাখ টাকা লোন নিয়েছি। সেটা দিয়ে সংসার চালিয়েছি। এখন ঋণের টাকাই বা পরিশোধ করবো কীভাবে? আর সংসার চালাবো কীভাবে? এই টেনশনে ঘুমাতে পারি না। চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখছি। প্রবাসী হিসেবে সরকার থেকেও কোনো সহযোগিতা পাইনি। অনেকের কাছে গিয়েছি কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, একটা মহামারি আমার জীবনটা এভাবে দুর্বিষহ করে তুলবে কখনো ভাবিনি। এক সময় আমার কোনো অভাব ছিল না। এখন আমি নিঃস্ব।
কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার জরিপের তথ্যমতে, করোনার আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) করা যৌথ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। গবেষণা বলছে- ২০২১ সালে নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চলমান করোনা মহামারিতে দেশে মোট শ্রমশক্তির তিন শতাংশেরও বেশি লোক কর্ম হারিয়েছেন এবং প্রায় দেড় কোটি লোক মহামারির প্রভাবে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, চাকরি হারানোদের মধ্যে ছয় দশমিক সাত শতাংশ শহরাঞ্চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। ২০২১ সাল শেষ হতে হতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মহীন হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছে এই বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।