রাজশাহী: করোনার সংক্রমণে বিপর্যস্ত রাজশাহী। বেড়েই চলেছে সংক্রমণ। নগরীর ১৩টি পয়েন্টে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে। এরপরও সংক্রমণের সার্বিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। সংক্রমণ ঠেকাতে গতকাল বিকাল ৫টা থেকে ১৭ই জুন রাত ১২টা পর্যন্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ১৭ই জুন মধ্যরাত পর্যন্ত রাজশাহী থেকে যাত্রীবাহী সকল ট্রেন চলাচলও বন্ধ থাকবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ এবং রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পোর্ট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে এই দুর্ভোগ অনেকটাই এড়ানো যেত।
এদিকে নগরীর ওষুধের দোকানগুলোতে সর্দি-কাশি, জ্বর ও ডায়রিয়া রোগের ওষুধ বিক্রির ধুম পড়েছে। তেরখাদিয়ার এরিক ফার্মার মালিক দুরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, গেল সপ্তাহ থেকে সর্দি-কাশি, জ্বরের রোগী বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ।
প্রাথমিক অবস্থায় এজিথ্রোমাইসিন, ফেক্সো ফেনাডাইন, মন্টিলুকাস্ট, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেয়ে অনেকে সুস্থও হচ্ছেন। আবার অনেকে প্রিভেন্টিভ ডোজ হিসাবে জিঙ্ক সালফেট, সিভিট, ইভেরা ওষুধ সেবন করছেন। নগরীর প্রায় সব এলাকার একই চিত্র।
মেহেরজান মেমোরিয়াল মেডিকেয়ারের ডা. আসাদুর রহমান বিপ্লব বলেন, শরীরে করোনার হালকা প্রাদুর্ভাবে কেউ সহজে হাসপাতালে যেতে চান না। করোনা রোগীর চাপ বেশি থাকায় হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা মূলত এন্টিবাইটিকস, এন্টিহিসটামিন জাতীয় ওষুধে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করেন। যখন সিভিয়ার হচ্ছে, রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে তখন করোনা টেস্ট করতে যান। ফলে বড় অংশকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। টেস্টের আওতায় যারা এসেছে তারা একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আমরা চেম্বারে এমন রোগীই পাচ্ছি বেশি। তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে করোনা টেস্টের পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ করোনা টেস্ট করে না, ফলোআপেও আসে না।
গত পাঁচদিন ধরে রাজশাহী নগরের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বুথে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষায় যাদের করোনা পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ উপসর্গহীন। মানুষের মধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা নিয়ে আগ্রহ, উদাসীনতা দেখা গেছে। জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগলেও পরীক্ষা করতে চান না অনেকে। কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না, সেটি র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমেও নিশ্চিত হওয়া যায়। সরকার বিনামূল্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। একটি কিটের সাহায্যে মাত্র কয়েক মিনিটেই পরীক্ষাটি সম্পন্ন করা যায়।
নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট বুথে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছিলেন সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সুপার মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই বুথে গত বৃহস্পতিবার ১০১ জনের মধ্যে ২৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৩.৭৬ শতাংশ। এদের কারোরই কোনো উপসর্গ ছিল না। তারা নিজের অজান্তেই অন্যদের সংক্রমিত করছেন।
দু’দিন ধরে হালকা মাথা ব্যথা জ্বর থাকায় গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় সময় টিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার সাইফুর ইসলাম রকি অফিসের ৫ জনকে নিয়ে সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট বুথে নমুনা পরীক্ষার জন্য আসেন। পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ এসেছে। অন্য ৪ জনের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তিনি বলেন, সন্দেহ হওয়ায় সর্তক ছিলেন এবং দুপুরে অফিসের সবাইকে করোনা টেস্ট করান। রিপোর্ট শুধু তারই পজিটিভ আসে। বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
এরআগে এটিএন নিউজের বুলবুল হাবিব সস্ত্রীক করোনা পজিটিভ হন। আক্রান্ত হয়েছেন মাছরাঙা টিভি’র রিপোর্টার গোলাম রাব্বানি। এছাড়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি’র রাজশাহী ব্যুরো মাইনুল হাসান জনির করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও তার স্ত্রীর পজিটিভ এসেছে। করোনা সংক্রমণের এমন চিত্র শুধু সাংবাদিকদের মধ্যে নয়, সকল পেশার মানুষের মাঝে দেখা যাচ্ছে।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ৫ দিন ধরে নগরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চলছে। শনাক্তও হচ্ছে। বেশির ভাগের উপসর্গ নেই। বেশি মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি নিজে থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। এতে অন্তত তার পরিবারসহ আশপাশের মানুষকে তিনি সংক্রমিত করবেন না।
সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা: করোনাভাইরাসে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রাজশাহীতে ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বিকাল ৫টা থেকে ১৭ই জুন রাত ১২টা পর্যন্ত সিটি এলাকায় সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত রাজশাহী সার্কিট হাউসে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠকে লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবীর বলেন, জেলায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ও মৃত্যু হার বিশ্লেষণ করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। লকডাউনের সময় সব দোকানপাট ও যানচলাচল বন্ধ থাকবে। চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ থেকে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না, রাজশাহী থেকেও কোনো যানবাহন জেলার বাইরে যাবে না। তবে রোগী ও অন্য জরুরি সেবাদানকারীর ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
এছাড়াও আমের বাজারগুলো বড় পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাজার পরিচালনা করার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে বলেন বিভাগীয় কমিশনার।
সভায় উপস্থিত ছিলেন, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন, মহানগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক, জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল ও স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা।
এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে অধিদপ্তর কেভিড-১৯ সংক্রমণের বিস্তার রোধকল্পে গতকাল হতে ১৭ই জুন মধ্যরাত পর্যন্ত রাজশাহী হতে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী যাত্রীবাহী সকল ট্রেন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।