করোনা মহামারীর কারণে লকডাউনসহ নানা সমস্যায় কাজ হারিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বহু মানুষ। ব্যয় নির্বাহে টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে বহু প্রতিষ্ঠান। ছোট ব্যবসায়ীরাও আছেন বিপাকে। বাধ্য হয়ে রাজধানীর ব্যয়বহুল জীবন ফেলে অনেকেই ফিরেছেন গ্রামে। মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তরা খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভেঙেছেন, সম্পদ বিক্রি করছেন। কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ চলমান পরিস্থিতিতে একমাত্র সরকারি কর্মীরা ছাড়া আর কেউই আয়-রোজগার নিয়ে এখন নিশ্চিন্ত নন। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এটিও সবার অজানা। এমনকি যাদের কষ্টার্জিত টাকা দেশের রেমিট্যান্সের অন্যতম বড় উৎস, সেই প্রবাসীদের অনেকেই ছুটিতে দেশে এসে আর ফেরত যেতে পারছেন না।
পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরেরও বেশি সময়ে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি থেকে বেড়ে ছয় কোটি হয়েছে। এমন এক দুঃসময়ে সরকারের দেওয়া জাতীয় বাজেটে নতুন পথনির্দেশনা দেওয়া হবে বলে প্রত্যাশা ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রস্তাবিত বাজেটে গতানুগতিক ধারার বাইরে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তেমন কিছু বরাদ্দ রাখেননি অর্থমন্ত্রী। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব তিনি নিখুঁতভাবে দিলেও গরিবের আয়-রোজগারের হিসাব মেলেনি বাজেটে।
আগামী এক বছরে রাষ্ট্রের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়েয় হিসাব জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। খরচের হিসাবে দেশের ইতিহাসে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি সবচেয়ে বড়। এখানে রাষ্ট্রের এক বছরের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সম্ভাব্য আয় আশা করা হচ্ছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় ব্যয়ের বাকি ঘাটতি ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা মেটানো হবে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ ও সাহায্যের মাধ্যমে।
অর্থমন্ত্রী তার ঘোষণায় একে জীবন ও জীবিকার প্রাধান্যের বাজেট হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতায় দেশে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু গত এক বছরে গরিব মানুষের সংখ্যা কী পরিমাণ বেড়েছে তার কোনো ইঙ্গিত দেননি। এমনকি দরিদ্রদের সহায়তায় বাছাই এবং সহায়তার কৌশল নিয়েও কোনো আলোকপাত করেননি। যার সমালোচনা করেছেন অনেকে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাজেটে করপোরেট সেক্টরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের ছাড় দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোয় নজর বেশি। কিন্তু দরিদ্র ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে কোনো নজর নেই। করোনার ছোবলে বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো আলোচনাই নেই বাজেটে। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় স্বাস্থ্য খাতে, সামাজিক সুরক্ষা ও জীবন-জীবিকা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের অংশে এসব খাতে গুরুত্ব নেই। অর্থাৎ মৌখিক ঘোষণা দিলেও বরাদ্দ আগের মতোই নিতান্তই কম।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদ খাতুন বলেন, ‘মহামারীর কারণে অনেক মানুষ নতুন করে দরিদ্রের কাতারে নেমে এসেছেন। অনেক মানুষের আয় কমেছে। অন্যদিকে আমরা দেখছি, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। অথচ সরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় এসএমই খাতে। কিন্তু সরকারের প্রণোদনা পেলেন মূলত বড় শিল্পমালিকরা। এ ছাড়া প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে মূলত ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেরই ব্যাংক হিসাব নেই। সে জন্য এনজিওগুলোর মাধ্যমে তাদের ঋণ দেওয়া উচিত।’
জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারী বিশ্বের অন্তত ১০ কোটি কর্মজীবী মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোয় এই মহামারীর প্রভাব অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে তিন কোটির মতো মানুষ গরিব। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম-এর খানা পর্যায়ের জরিপের তথ্য বলছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। নতুন-পুরনো মিলে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয় কোটি। আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপের তথ্য বলছে, করোনার কারণে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ গরিব হয়েছেন। সিপিডির হিসাবে নতুন করে দেশে গরিব হয়েছেন ১ কোটি ৬৮ লাখ মানুষ।
জানা গেছে, চলমান লকডাউনসহ নাজুক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারী, পর্যটনসংশ্লিষ্ট কর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী, পরিবহন কর্মী, সুপারশপ ও শপিংমলের কর্মীরা। যাদের বেশিরভাগই কর্মস্থল ছেড়ে গিয়ে গ্রামে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর বাইরে বেসরকারি বহু কারখানা ও প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। আবার কেউ বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন। অনেকে আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি করছেন। অথচ এদের জন্য তেমন কিছু রাখা হয়নি বাজেটে। নেওয়া হয়নি তাদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া ও কাজ হারিয়ে যারা বেকার হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগও।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘করোনা অতিমারীর দ্বিতীয় ধাক্কা চলাকালে এ বাজেট দেওয়া হলো। প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বিপর্যয় নেমে আসে। মানুষের জীবন ও জীবিকা বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে। নব্বইয়ের দশকের পর এ বছর প্রথম নতুন করে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সবার জন্য বরাদ্দ না থাকায় বেড়েছে নিম্নআয়, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নারী-শিশুদের দুর্ভোগও। কিন্তু বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ আসেনি। অথচ করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অন্যান্য দেশ গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে পরিকল্পনা করে বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের নতুন বাজেট গতানুগতিক ধারার বাইরে যেতে পারেনি। করোনার ক্ষতি চিহ্নিতকরণ এবং মোকাবিলায় কোনো ধরনের নীতি-কৌশলের কথা বাজেটে স্থান পায়নি। এটি সবচেয়ে জরুরি ছিল যে কর্মহীন মানুষ কীভাবে কাজ পাবে, তাদের হাতে নগদ টাকা কীভাবে যাবে।’
সরকারি সূত্র বলছে, করোনা মহামারীর অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। স্বল্পসুদে ঋণ হিসেবে এই অর্থের সিংহভাগই পেয়েছেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিরা। কৃষক পর্যায়ে সামান্য অর্থ বিতরণ করা হলেও সারাদেশে কাজ হারানো প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কোনো সহায়তা পাননি। নতুন প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যবসা-বাণিজ্যকে চাঙ্গা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কোনো খাতে কর আরোপ করা হয়নি। বরং অনেক খাতেই করহার কমানো হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য শুল্ক-কর ছাড় সুবিধা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের উদ্যোক্তা অধ্যাপক মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘বহু মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। বেকারদের ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। তবে নতুন বাজেটে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিকে গতানুগতিক ঘোষণা হিসেবে না দেখে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে গরিব মানুষেরও কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
সমাজের অসহায় মানুষদের সহায়তার জন্য বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রতিবছরই বরাদ্দ থাকে। এ বছরও এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এই বরাদ্দ সমাজের একেবারে অসহায় শ্রেণি যেমন- বয়স্ক, বিধবা এর বাইরে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবৃত্তি এসব খাতগুলোতেই বেশি খরচ হয়। গত অর্থবছরে এ খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকা, যা খরচ করেও এখনো এই শ্রেণির ৪৬ শতাংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে রয়েছেন। নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা হলেও তাদের শতভাগ কর্মসূচির আওতায় আনা যাবে না। ফলে নতুন গরিব মানুষের এই খাত থেকে অর্থ পাওয়ার কোনো সুযোগই থাকছে না।