হঠাৎ করে বেড়েছে নৃশংস খুনের ঘটনা। বীভৎস কায়দায় খুন করা হচ্ছে। খুনের পর লাশ গুমের উদ্দেশ্যে খণ্ডবিখণ্ড করা হচ্ছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে ঘটছে এসব খুনের ঘটনা। একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে জনমনে। যদিও চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনার ক্লু বের করতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে এবং ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনাও মিলছে ঘাতকদের মুখে।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে শাহীন উদ্দিন নামে এক যুবককে কুপিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
গত ১৬ই মে বিকাল ৫টার দিকে মিরপুর ১২ নম্বরের ডি-ব্লকে এ ঘটনা ঘটে। জমি সংক্রান্ত পূর্ব শত্রুতার জেরে শাহীনকে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ। পুলিশ জানায়, শাহীনের সঙ্গে তার প্রতিপক্ষের আধিপত্য বিস্তার ও জমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং শত্রুতার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এ ঘটনায় সাবেক এমপি আউয়ালসহ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজধানীর দক্ষিণখানে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে পোশাককর্মী আজহারুলের অর্ধগলিত সাত টুকরো মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আসমা ও তার পরকীয়া প্রেমিক দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার শেষে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশ জানায়, আজহারের ছেলে আরিয়ান এবং আজহার দু’জনেই আব্দুর রহমানের কাছে কোরআন শিক্ষা নিতেন। সেই সুবাদে আসমার সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ান ইমাম আব্দুর রহমান। নিহত আজহারুল পেশায় একজন গার্মেন্টস কর্মী ছিলেন। তিনি দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকার ইউসুফ গাজীর ৩৯ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকতেন। গত ১৯শে মে রাতে মসজিদে ইমামের কক্ষে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে আজহারকে ছুরি দিয়ে হত্যা করে আব্দুর রহমান। এরপর ছুরি ও রাম দা দিয়ে মরদেহ টুকরো টুকরো করে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে ফেলে সে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডটি প্রথমে ক্লুলেস ছিল। পরে পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে আসামিকে গ্রেপ্তার ও মূল ঘটনা উদ্ঘাটন করে।
গত ৩০শে মে রাত ৯টার দিকে মহাখালী আমতলী সড়কের পাশে একটি নীল রঙের ড্রামের ভেতরে বস্তাবন্দি অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহটি হাত-পা ও মস্তকবিহীন অবস্থায় ছিল। নিহত ওই ব্যক্তির নাম ময়না মিয়া। দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামী ময়না মিয়াকে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে অচেতন করে হত্যা করে প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। পরে লাশ ছয় টুকরো করে বস্তায় ভরে তিনটি এলাকায় ফেলে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় ময়না মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী বাদী হয়ে বনানী থানায় মামলা করেন। ফাতেমাকে গ্রেপ্তারের পর খুনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পায় পুলিশ।
সোমবার রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে কাজী সাবিরা রহমান লিপি নামে এক চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের বাড়ির নিজ ঘর থেকে চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধার করে কলাবাগান থানা পুলিশ। ডা. লিপি রাজধানীর পান্থপথের গ্রীন লাইফ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের কোনো কারণ জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে কয়েকটি ক্লু নিয়ে কাজ করছেন তারা। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহ পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় ডাক্তার লিপির বাসার সাবলেটের বাসিন্দা কানিজ সুবর্ণা, তার এক বন্ধু ও বাসার দারোয়ান রমজানকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, লকডাউন ও বিধিনিষেধের মধ্যেই গত এক মাসে রাজধানীতে ১৮টি খুন ও ৩৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। লকডাউনে রাজধানীজুড়ে পুলিশের তৎপরতা ও চেকপোস্টের মধ্যেই হত্যাসহ এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগেরই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সূত্র জানায়, ঢাকায় প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইনকানুনের প্রতি তোয়াক্কাহীন মনোভাবের কারণে কথায় কথায় খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। এর পেছনে পরকীয়া, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ, অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, মাদকের অর্থ জোগাড়, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা।
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম বলেন, গত মাসে পল্লবীতে চাঞ্চল্যকর শাহীন উদ্দিনকে কুপিয়ে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় হত্যা মামলা হলেও এর বাইরে মাদক এবং ধর্ষণ মামলার সংখ্যা বেশি। কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক ঠাকুর মালো বলেন, নারী চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনার বাইরে গত মাসে উল্লেখযোগ্য হত্যা মামলা হয়নি।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, গত মাসে একাধিক মাদক মামলা হলেও হত্যাকাণ্ডের কোনো মামলা এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়নি। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, সম্প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ছোটখাটো বিষয়ে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বরত হিসেবে বলতে চাই, একটি অসহিষ্ণু আচরণ আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করছি। সামাজিক, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, লকডাউনে দীর্ঘসময় বাসায় থাকা ইত্যাদি কারণে হয়তো মানুষের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে এক ধরনের আচরণগত পরিবর্তন দেখা গেছে। যেটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।