কুষ্টিয়া: শত শত গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ না করায় সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদসহ সাতজনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার আদালতে একাধিক প্রতারণা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত ৯ মামলায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে ৩০ কোটি টাকার বেশি পাওনা হয়েছে গ্রাহকদের। কুষ্টিয়া ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইলসহ আরো কয়েকটি জেলায় কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেসব মামলার কয়েকটিতে ওয়ারেন্টও জারি হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকে তাদের বীমা দাবি টাকা পরিশোধ না হওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। তবে মামলা দায়ের হলেও বীমা কোম্পানিটির মালিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
অভিযোগ উঠেছে, বছরের পর বছর ধর্না দিয়েও গ্রাহকরা বীমার টাকা আদায় করতে পারছেন না। উল্টো গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ১০ বছর মেয়াদি জীবনবীমা পলিসি করেছেন এমন একজন হলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মনিরুজ্জামান ডাবলু। মেয়াদপূর্তির পর এক টাকাও পাননি তিনি। আদালত ও বীমা কোম্পানিতে ঘুরতে ঘুরতে চার বছর পার হয়েছে। তার মতো আরেক ভুক্তভোগী দৌলতপুর উপজেলারই মুক্তার হোসেন।
তিনি জানান, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে ১০ বছর মেয়াদি জীবনবীমা পলিসি করেছিলাম। মেয়াদপূর্তির পর তারা টাকা দিচ্ছে না। কথা ছিল মেয়াদপূর্তি হলে একবারে ডাবল (দ্বিগুণ) টাকা দেবে। কিন্তু এখনো কোনো টাকা দেয়নি, উল্টো হয়রানি করছে। তাদের কাছে ঘুরতে ঘুরতে যখন কোনো কাজ হলো না তখন বাধ্য হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।’
অপর এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করে শর্তে বলেন, ‘পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় সাত বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো এক টাকাও পাইনি। ডাবল টাকা তো দূরের কথা, আসল টাকাই ফিরে পাচ্ছি না’।
‘বাংলাদেশের অনেক বীমা কোম্পানি ভুয়া। ভেবেছিলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরিবারের সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স হয়তো নিরাপদ হবে। কারণ, তিনি সরকারের মন্ত্রী। এজন্য কোম্পানির অফিসারদের সাথে কথা বলে বীমা করেছিলাম। কোম্পানির কর্মীরাও আমাদের বুঝিয়েছিল যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এখানে কোনো সমস্যা হবে না। পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হলেই পাওয়া যাবে ডাবল টাকা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলে এখন টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। অনেক সময় হুমকির সম্মুখীনও হতে হচ্ছে,’ যোগ করেন ওই ভুক্তভোগী।
এ নিয়ে কুষ্টিয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (দৌলতপুর) আদালতে দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের হাকিম জোয়ার্দ্দারের ছেলে বশির আহমেদ, একই ইউনিয়নের মো: শামসুর রহমানের ছেলে হাবিবুর রহমান ও মনিরুজ্জামান ডাবলু বিভিন্ন সময় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলার আসামিরা হচ্ছেন- সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রুবিনা হামিদ (স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোন), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো: নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আসলাম রেজা, অডিট অফিসার মো: সাইদুর রহমান খান ও কোম্পানি সচিব মো: রবিউল ইসলাম। এছাড়া মামলায় আরো দুজনকে আসামি করা হয়েছে যাদের নাম জানা যায়নি।
ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের অফিস রাজধানীর বনানীতে। কুষ্টিয়া থেকে বনানী থানায় ওয়ারেন্ট গেলেও একটিরও তামিল হয়নি বলে অভিযোগ করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী আব্দুল মতিন খন্দকার।
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী আব্দুল মতিন খন্দকার বলেন, ‘গ্রাহক প্রতারণায় কোম্পানির চেয়ারম্যান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদসহ সাতজনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এখন পর্যন্ত আমার কাছে এ সংক্রান্ত মোট ১১টি মামলা আছে। মোট গ্রাহক ৪৯৭ জন। মোট অর্থের পরিমাণ ৯০ লাখ ৬২ হাজার ৯২৬ টাকা। ৯টি মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। দুটি মামলা লকডাউনের জন্য স্থগিত আছে। এরমধ্যে ছয়টি মামলার ওয়ারেন্ট সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয়েছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কুষ্টিয়ার মামলার বিষয়ে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। করোনার কারণে কিছু ল্যাকিং (ঘাটতি) তৈরি হয়েছিল। আশা করি আগামী (জুন) মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।’
তিনি দাবি করেন, ‘কোম্পানির আগের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে বেশকিছু বীমা দাবি আটকে ছিল। আমরা ইতোমধ্যে ৩-৪টি মামলার দাবিগুলো পরিশোধ করেছি। লকডাউনের কারণে কিছু মামলার দাবি পরিশোধ করতে পারিনি। শুনেছি, আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আমরা দ্রুত এ বীমা দাবিগুলো পরিশোধ করব।’
এদিকে, শত শত গ্রাহকের দাবি করা অর্থ পরিশোধ না করায় চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন বীমা কোম্পানিটির মাঠকর্মীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানিটির কয়েকজন কর্মী বলেন, এ এলাকায় শত শত গ্রাহক বছরের পর বছর টাকা পাচ্ছেন না। গ্রাহকরা দলবেঁধে কখনো অফিস ঘেরাও করছেন, কখনো আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন। কখনোবা টাকা আদায়ে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী বা প্রভাবশালীদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন। অবস্থা এমন, পাওনাদার গ্রাহকদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ও সার্ভিস সেল ইনচার্জরা। প্রতিদিনই অফিসে ভিড় করছেন শত শত গ্রাহক।
‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বললে তারা বলেন, সামলান। নতুন প্রিমিয়াম নেন, গ্রাহকদের টাকা দেন। প্রধান কার্যালয়ে গ্রাহকদের তালিকা নিয়ে দিনের পর দিন ধর্না দিয়েও কোনো কাজ হয় না। আমরা তো মালিকদের কাছে যেতে পারি না। কী করব, আমরা এর কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না,’ যোগ করেন তারা।