ঢাকা: ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা, তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। সিলেটে পর পর গত দুই দিন বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প সেই বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করে উল্লেখ করে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপিত আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দেশে ‘বিপজ্জনক ভূকম্পনের’ প্রধান দুটি উৎস আছে।
এর একটি হচ্ছে ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ‘ফল্ট’। সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার লালাখালসংলগ্ন এলাকা বিপজ্জনক ডাউকি ‘ফল্টের’ পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি। আরেকটা হচ্ছে টেকনাফ-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকশন জোন।
তিনি বলেন, সামান্য তিন মাত্রার হলেও ৩০-৪০ মিনিটের ব্যবধানে ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়ায় সিলেটবাসী আতঙ্কিত হয়ে গেছে। একই এলাকায় মোট ছয়বার কম্পন হয়েছে। এটিকে ‘আফটার শক’, ‘ফোর শক’ কিছুই বলা যাবে না। এ ভূকম্পন একটা ইঙ্গিত বহন করে যে, এটি সক্রিয় এবং ভবিষ্যতে এখানে বড় মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে।
জানা গেছে, পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার ছোট-বড় ১৩টি খ-ে (প্লেটে) বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম এস্তোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো গতিশীল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় ভূখ- ধীরে ধীরে সরতে থাকে, যেটিকে ‘অ্যাকটিভ ফল্ট’ বা সক্রিয় চ্যুতি বলা হয়। প্লেটের স্থানচ্যুতির সময় জমে থাকা শক্তি বিপুল বেগে বের হয়, তখন সংযোগস্থলে ভূকম্পন হয়। বাংলাদেশের উত্তরে ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটের ডাউকি অঞ্চলে রয়েছে এমন ফল্ট। আর ‘সাবডাকশন জোন’ সমুদ্র তলদেশের এমন এলাকা যেখানে দুটি টেকটনিক প্লেট মুখোমুখি অবস্থানে থাকে এবং প্লেট দুটি পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এমন অবস্থায় একটি টেকটনিক প্লেট আরেকটি নিচে চলে গেলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূল বরাবর বঙ্গোপসাগরের এক বিশাল ‘সাবডাকশন জোন’ রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মমিনুল ইসলাম বলেন, সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে যে এখানে বড় ধরনের ডাউকি ফল্ট রয়েছে। সিলেট থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে এ চ্যুতি। ফল্টলাইনগুলোকে ভূকম্পন হয়।
তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্প হবেই, এখন সচেতনতামূলক প্রস্তুতি নিতে হবে। এর মধ্যে ‘বিল্ডিং কোড মেনে’ ভবন তৈরি করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি না করলে দুর্যোগে উদ্ধার কাজও ব্যাহত হবে। প্রস্তুতি থাকতে হবে যেন নিয়ম মেনে স্থাপনা তৈরি করতে হবে। তাতে ছোট-মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছে আর্থ অবজারভেটরি। ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তার গবেষণা মডেল বলছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার জানান, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। একটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা হচ্ছে আমাদের পূর্বে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি অঞ্চলে। এখানে আসলে দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্প আমাদের বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। উত্তর প্রান্তে যেটি ডাউকি ফল্ট এখানে সংকোচনের হার হচ্ছে প্রতি একশ বছরে এক মিটার। গত ৫শ থেকে ৬শ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো রেকর্ড নেই। তার মানে ৫-৬ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। এটি যদি আমি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করি তা হলে এটি হচ্ছে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। ঢাকার মধ্যে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো ভূতাত্ত্বিক অবস্থা না থাকলেও সিলেট এবং চট্টগ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার জানান, ১৯২২ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল হবিগঞ্জ অঞ্চলে; ১৯১৮ সালেও ৭.৫ মাত্রার হয়েছিল। চার বছরের ব্যবধানে বড় ভূকম্পন ছিল শত বছর আগে। এক মাস আগে ডাউকি ফল্টেরই উত্তর প্রান্তে আসাম সীমান্তে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তার মানে এ ‘ডাউকি ফল্ট খুব সক্রিয়’। ডাউকি ফল্ট ও টেকনাফ সাবডাকশন জোনে হাজার বছর ধরে যে পরিমাণ শক্তি ক্রমান্বয়ে সঞ্চয় হয়ে আসছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূকম্পন সংগঠিত করতে পারে। এ শক্তি একবারেও বের হতে পারে; আবার আংশিক বের বের হতে পারে। সেটি আমরা বলতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, ঝুঁকি রয়েছে, সে জন্য আমরা হুমকির মুখেও রয়েছি। ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবিলায় মানসিক প্রস্তুতি দরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভূমিকম্প সহনীয় নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ। এ বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল আগে থেকেই ঝুঁকিতে আছে। এ অঞ্চলে অতীতে তিনবার বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস আছে। এ কারণে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা এখনো রয়েছে। ফাটলগুলো সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়ায় সেটি নাড়াচাড়া দিতে পারে। ছোট ছোট ভূমিকম্পের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি মানে এ নয় যে, এখানে আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমানে সেখানে প্রস্তুতি খুবই কম।
এদিকে সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন ভূমিকম্পে করণীয় জরুরি সভা ডেকেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী ২০১৯-এর ৩.১.৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আগামীকাল মঙ্গলবার ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরবর্তী সময় করণীয় নির্ধারণে সভায় আলোচনা করা হবে।
এদিকে শনিবার ও রবিবারের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনির ফলে সিলেট শহরে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ ভয়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে শহুরে কংক্রিটের দালান ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।
সিলেট সদরে বাসিন্দা হামিদা ইসলাম বলেন, পরপর দুই দিন ভূমিকম্প হওযায় আমরা খুবই আতঙ্কে আছি। আমাদের ভবনের এক পরিবার ইতোমধ্যে গ্রামে চলে গেছেন। আরও অনেকে গ্রামে বাসা খুঁজছেন বলে শুনছি। আতঙ্কে আমার দুই মেয়ে রাতে ঘুমাতে পারছে না। স্বজনরা আমাদেরও অন্যত্র যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আসলে কী হবে বুঝতেছি না।
উল্লেখ্য গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে ৫ দফা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেট অঞ্চল। গতকাল রবিবার ভোরেও একদফা ভূমিকম্প হয়।