সারাবিশ্ব মহামারী করোনায় আটকে গেছে। একটি দেশ তাদের ইতিহাস থেকেই ২০২০ মুছে ফেলেছে। ইতিহাস মুছলেই তো আর ইতিহাস জিরো হয়ে যায় না। ইতিহাস প্রাকৃতিকভাবেই লেখা হয়। ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া আরেকটি ইতিহাস। চলমান ২০২১ আগের বছরের চেয়ে বেশী খারাপ না ভালো তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে বিশ্বের সকল দেশের ন্যায় বাংলাদেশও করোনা মোকাবেলায় চেষ্টা করে যাচ্ছে বিরামহীনভাবে। বাংলাদেশের আত্মরক্ষার চেষ্টার সময় প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এই সময়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।
সরকার জীবন ও জীবিকা সংরক্ষনের জন্য মাঝে মাঝে নানা ধরণের বিধি নিষেধের আদলে কথিত লকডাউন দিচ্ছে। কাগজে কলমে লকডাউন লিখা না থাকলেও শব্দটির প্রচলন হয়ে গেছে। দেড় বছর ধরেই বিভিন্ন ধরণের অলিখিত লকডাউন চলছে। এই কারণে খোলছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানুষের বেঁচে থাকার উপকরণগুলো মাঝে মাঝে খুলে দিলেও একবারও খোলা হয়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে সম্পূর্ন কর্মহীন হয়ে গেছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। এতে করে দীর্ঘ সময় কাজ না থাকায় অলস সময়ে শিক্ষার্থীরা অকাজে সময় ব্যয় করছে আর শিক্ষকেরা রোজগার না থাকায় নানা পেশায় নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। এরই মধ্যে অকাজ করতে করতে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা যেমন করছেন, খাবার না পেয়ে অনেক শিক্ষকও আত্মহত্যা করেছেন। ধনীর দুলালীরা মাদকাসক্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে যেমন ঢলে পড়ছেন তেমনি ক্ষুধার্থ শিক্ষকও নিজ সন্তানের খাদ্য জোগার করতে না পেরে নিজেই নিজের খুনী হতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাপী অতিমারী করোনার ছোবলে বাংলাদেশে জাতীয়, সামাজিক ও নৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষা ক্ষেত্র। কারণ আজকের প্রজন্ম আগামী দিনে দেশ চালাবে। প্রজন্ম শিক্ষিত হতে না পারলে ভবিষৎ চালকেরা মূর্খ হয়ে যাবে। লেখাপড়া না করে অটো পাশের সংস্কৃতি বহমান থাকলে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়াই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা দেশপ্রমিক হযে যাবেন। ফলে একটি সময় আমরা মূর্খ জাতিতে পরিণত হব।
গণমাধ্যম বলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা ও বেঁচে থেকে অনলাইন জুয়া ও মাদকের দিকে অগ্রসরতা বাড়ছে। এসব ছাড়াও শিক্ষার্থী কখনোবা শিক্ষকেরাও অপরাধের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সবশেষ ঘটনা মাদকে বিভ্রম ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের। তারপর মানসিক ভারসাম্যহীনের মতোই হলের মাঠ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। একাধিক রিকশাচালকের পা চেপে ধরে ক্ষমা চান। একপর্যায়ে ফুটপাথে থাকা ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় আঘাত করেন হাফিজুর। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে প্রকাশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভয়ঙ্কর এক মাদকে আসক্ত ছিলেন হাফিজ। এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড)।
এলএসডি কী?
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ যা রাই এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয়।
এটি স্বচ্ছ, গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে, এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়।
এলএসডি’কে ‘সাইকাডেলিক’ মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধরনের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশেপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো ‘হ্যালুসিনেট’ বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষও করে থাকে।
১৯৩৮ সালে প্রথমবার এলএসডি সংশ্লেষণ করা হয়। এরপর ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে নানা ধরনের মানসিক রোগের চিকিৎসায় এলএসডি ব্যবহারের জন্য প্রচারণা চালান গবেষকরা। সেসময় এই বিষয়ে বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয়, আয়োজিত হয় একাধিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনও।
১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এলএসডিসহ সব ধরনের সাইকাডেলিক ড্রাগ নিষিদ্ধ করে। এরপর ১৯৭১ সালে জাতিসঙ্ঘ চিকিৎসা কাজে এলএসডি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে এই বিষয়ে গবেষণায় ভাটা পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে আসে যে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে নির্দিষ্ট মাত্রায় এলএসডি গ্রহণের ফলে অসুস্থতার কারণে দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকা রোগীদের দুশ্চিন্তা কমে।
এলএসডি কেন ক্ষতির কারণ হতে পারে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার প্রয়োজনে বা গবেষণার কাজে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে নির্দিষ্ট মাত্রায় এলএসডি গ্রহণ করে থাকে মানুষ। তবে এটি মূলত ব্যবহার হয়ে থাকে মাদক হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি মানুষের মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের কার্যক্রম প্রভাবিত করে ব্যবহার, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করে।
এলএসডি নেয়ার পর সাধারণত মানুষ ‘হ্যালুসিনেট’ করে বা এমন দৃশ্য দেখে যা বাস্তবে নেই। অনেক সময় অলীক দৃশ্য দেখার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে মানুষ।
এলএসডি গ্রহণ করে ভুল রাস্তা দেখে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, বাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়া বা অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা নথিবদ্ধ রয়েছে।
ইউরোপের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট রিসার্চগেইট’এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয় এলএসডি গ্রহণের পরবর্তী জটিলতায়।
বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় ভোগা ব্যক্তিরা এলএসডি গ্রহণের পর আরো বেশি বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে পারেন বলেও উঠে এসেছে অনেক গবেষণায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, এলএসডি গ্রহণের পর অনেকে মনে করেন যে তিনি সবকিছু পরিষ্কার দেখছেন এবং তার শরীরে অতিমানবিক শক্তি এসেছে। এরকম বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার ফলেও অনেকে নানা ধরনের দুর্ঘটনা শিকার হতে পারেন।
অতিরিক্ত আতঙ্কের কারণে মানুষ অনেক সময় মনে করতে পারে যে সে শিগগিরই মারা যাবে বা মারা যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতেও মানুষ আতঙ্কের বশবর্তী হয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
আতঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশি অতি দ্রুত অনুভূতির পরিবর্তন হওয়ার কারণেও মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করতে পারে বলে বলছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন।
সংস্থাটি বলছে, এলএসডি গ্রহণের আগে এটা বোঝা সম্ভব নয় যে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন হতে যাচ্ছে।
এছাড়া এলএসডি মানুষের শরীরে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে থাকে।
এলএসডি নেয়ার ফলে মানুষের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা এবং শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, অতিরিক্ত ঘামসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যাও তৈরি হয় বলে জানাচ্ছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন।
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে?
পশ্চিমা বিশ্বের হিসেবটা হচ্ছে এরকম- আত্মহত্যার শিকার শতকরা ৩০-৯০ জন বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনের ভুগে থাকেন, ৪৩-৫৪ জন অ্যালকোহল বা অন্যান্য মাদকে আসক্ত থাকেন, ৩-১০ জন স্কিজোফ্রেনিয়া অথবা Bipolar Mood Disorder রোগে ভুগে থাকেন, ২-৭ জন Organic Mental Disorder এবং ৫-৪৪ জন Personality Disorder-এ ভুগে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, একজন সুস্থ মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেন না। আত্মহত্যার পেছনে তার কোনো সাইকোলজিকাল ডিস্টার্বেনস (disturbance) থাকতেই হবে। তার অধিকাংশকেই চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলা এবং বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এ কাজটা করবে কে? কেউ যদি এ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে তার পরিণতি কি তাকে ভোগ করতে হবে? সম্ভবত পরিণতি ভোগ করতে হবে না। কারো চাকরি যাবে না, লাইসেন্স স্থগিত হবে না, বদলিও হবে না, হাসপাতাল বা ওয়ার্ড বন্ধ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হাসপাতালে ডিরেক্টরকে তো এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেই যাবে না।
বাংলাদেশে মোট কতজন লোক প্রতিবছর আত্মহত্যা করে? সরকারি হিসাব থাকলে থাকতেও পারে। তবে সেই হিসেবের চাইতে অনেক বেশি লোক আত্মহত্যা করে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ২০১০ সালের একটি স্টাডি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুসারে ১৯,৬৯৬ জন লোক আত্মহত্যা করেন (অধ্যাপক ঝুনু শামসুন নাহার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ‘আত্মহত্যা বা সুইসাইড নিয়ে কিছু কথা’)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন ১০,২৫৬ জন। আরেকটি হিসেবে দেখা গেছে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন ১১ হাজারের মতো মানুষ (আসমাউল মুত্তাকিন, মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?)
দু’দিন আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্নি ডাক্তার নশিন সাইয়ারা অদ্রি আত্মহত্যা করেছেন। এর আগেও অনেক ডাক্তার আত্মহত্যা করেছেন। নিরক্ষর মানুষের কথা বাদ দিলেও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত লোকজন কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর কেন আত্মহত্যা করলেন? মুনিয়া কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল? ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন যাদের মধ্যে ১১ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর আত্মহত্যার কারণ কী? ওদেরকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজ কী করেছে? দায়িত্বে অবহেলা করার কারণে কারো কি কোনো শাস্তি হয়েছে? ভুল থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে? ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলে পরবর্তী আত্মহত্যা বন্ধ করবেন কীভাবে?
পরিস্থিতি বলছে, শিক্ষালয় এখনি খুলে দেয়া উচিত। না হয় অপরাধী যেমন বাড়বে তেমনি অকাল মৃত্যুর ঘটনাও হু হু করে বাড়বে। একই সঙ্গে দিন দিন আমরা মূর্খতার দিকে অগ্রসর হব। বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, এলএসডিরমত ভংঙ্কর মাদকে যেহেতু আমাদের প্রজন্মকে গিলে ধরেছে সুতরাং এখনি শিক্ষ প্রতিষ্ঠান খোলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ক্লাশে বসান। কারণ বাইরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বইছে। ঘুর্ণিঝড়ের মধ্যে দানব দাঁড়িয়ে আছে। দরজা না খুললে দানবেরা এদের ধরে নিয়ে গিয়ে নতুন দানব বানাবে। আর তখন আর তাদের ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্লাশে আনতে না পারলে আমরা সব হারিয়ে ফেলবো। তখন আর অনুশোচনা করে কোন লাভ হবে না।
লেখক
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী