১. চোখ মেলে দেখলাম ঘড়িতে সকাল ন’টা। ইংল্যান্ডের শনিবার সকাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ভোরে উঠে হাসপাতালে যাবার জন্য রেডি হবার কোনো তাড়া নেই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত করার কোনো ব্যাপার নেই। তাই একটু দেরি করেই বিছানা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু সকাল ন’টার টেলিফোন কল আমার সেই প্রস্তুতিতে শুধু ব্যাঘাত ঘটিয়ে ক্ষান্ত দেয়নি বরং আমার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতার বীজ বুনে দিল। মিলিন্ডা(সোশ্যাল ওয়ার্কার) আমাকে এত সকালে ফোন করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো।
সাথে সাথে আমাকে যে দুঃসংবাদ দিলো তা হচ্ছে, গতকাল দুপুরে আমরা যে রোগীকে দেখেছিলাম সেই মেয়েটি রাতের বেলা গলায় দড়ি দিয়ে বাসায় আত্মহত্যা করেছে।
২.শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেল। মিলিন্ডার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো। আমার পক্ষে বিছানায় থাকা সম্ভব হলো না। বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে সকালের নাস্তা হিসেবে অর্ধেক পাউরুটি আর ছোট একটি কলা খেয়ে আমি আমার স্টাডি রুমে পায়চারি করতে থাকলাম। ল্যাপটপ নিয়ে টেবিলে বসলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম, কি হয়েছিল গতকালকের অ্যাসেসমেন্টে? যা স্মরণে ছিল তা আবার বিস্তারিতভাবে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম এবং পুরো অবস্থা ওয়ার্ড ডকুমেন্টে লিখতে লাগলাম। কিছু ভুলে যাবার আগেই আমাকে যতটা সম্ভব বিস্তারিত নোট নিতে হবে। এই নোটের উপর আমার অনেক কিছুই নির্ভর করবে।
৩. সোমবার(বৃটেনের শনি-রোববার সাপ্তাহিক ছুটি) সকালে আমাকে মেডিকেল ডিফেন্স ইউনিয়নকে (Medical Defense Union) ফোন দিয়ে আত্মহত্যার এই ঘটনা জানাতে হবে। মেডিকেল ডিফেন্স ইউনিয়নকে প্রতিমাসে আমাকে প্রায় বিশ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ধরনের ঘটনায় বা অন্য কোনো ঝামেলা হলে তারা আমাকে ডিফেন্ড করতে এগিয়ে আসবে। কোট-কাচারি হলে সেখানে নিজস্ব আইনজীবী পাঠাবে।
৪. কয়েক সপ্তাহের ভেতরে হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ (internal investigation) তদন্ত হবে। তারপর আমাকে মুখোমুখি হতে হবে Coroner’s Court-এ। ওখানে আমাকে আমার জবানবন্দি দিতেই হবে। কেন আমি/আমরা এই আত্মহত্যা ঠেকাতে পারলাম না? আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা দক্ষতায় কোন ঘাটতি ছিল? কোর্টে আমাকে মুখোমুখি হতে হবে আত্মহত্যার শিকার সেই রোগীর আত্মীয়স্বজন ও আইনজীবীদের এবং উৎসাহী সাধারণ মানুষের। অনেক কিছুই করতে পারে সেই আদালতে। কোর্টের সিদ্ধান্তের উপর ঝুলে থাকবে আমার ডাক্তারি পেশার ভবিষ্যৎ। সিদ্ধান্তের উপর অনেকের চাকরি জীবন নির্ভর করবে। আমি আরও এক গ্লাস পানি খেলাম।
৫. ইংল্যান্ডে বা বৃহত্তর যুক্তরাজ্যে প্রতিটি আত্মহত্যার খবর সংশ্লিষ্ট রোগীর সাথে জড়িত ডাক্তার, সোশ্যাল ওয়ার্কার, হাসপাতালের ডিরেক্টর, ওয়ার্ডের ম্যানেজার এবং নার্সদের জন্য একেকটি দুঃস্বপ্ন। রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট ভূমিকা পালন না করার কারণে কিছু কিছু ডাক্তারের লাইসেন্স চলে গেছে বা স্থগিত হয়ে গেছে ফলে তারা আর কখনো ডাক্তার হিসেবে সারা জীবনের জন্য বা নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত প্র্যাক্টিস করতে পারবেন না। হাসপাতালের ওয়ার্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এমনকি হাসপাতালের ওয়ার্ড, ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের চাকরি চলে গেছে, জেল জরিমানা হয়েছে। এই তালিকা থেকে হাসপাতালে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি ডিরেক্টরেরও কোনো অব্যাহতি নেই। এই ভয়ের কারণেই প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা চিকিৎসার সঙ্গে আমরা যারা জড়িত তাদের জন্য দুঃসংবাদ। রোগীকে আমি যদি না দেখে থাকি তাহলে সর্বশেষ যে ডাক্তার দেখেছেন তাকে আদালতে ডাকা হবে। একই অবস্থা সোশ্যাল ওয়ার্কার বা নার্সের ক্ষেত্রেও কার্যকর। বলা বাহুল্য, ইংল্যান্ডের প্রতিটি রোগীর কনসালটেশন কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। আমি রোগী দেখিনি- এমনটা বলার সুযোগ নেই। আত্মহত্যার আগে যে কোনো কারণেই হোক রোগী কাউকে-না-কাউকে দেখেছেন। সেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে উনি তাকে বাঁচানোর জন্য কী করেছিলেন।
৬. আমি যে রোগীর কথা বলছি ওর নাম লরা। স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছিল। পরীক্ষার চাপে গত কয়েক সপ্তাহ থেকে একটু বিষণ্নতা পেয়ে বসেছিল। মূল পরিবার লন্ডনে থাকলেও তাদের সাথে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। লরা লন্ডন থেকে প্রায় দেড়শ’ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকত। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এক বান্ধবীর বাসায় সে উঠেছিল। অপেক্ষা করছিল কখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে। সামনে এসাইনমেন্ট অপেক্ষা করছিল। লন্ডনে বসবাসরত মা-বাবার সাথে কিছু তিক্ততা চলছিল। এসব মিলিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ থেকে একটু বিষণ্ণতায় ভুগছিল লরা। ওর বান্ধবী গতকাল তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। কারণ মাঝেমধ্যে সে আত্মহত্যার কথা বলছিল। আমরা তাকে লম্বা সময় নিয়ে দেখেছি। লরা আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, সে ঔষধ খাবে এবং বাসায় ফিরে গেলে নিরাপদ থাকবে। আমরা তাকে একটি ইমারজেন্সি ফোন নম্বর দিয়েছিলাম। সে সেই নম্বরে ফোন করেনি। রাতে এক সময় লরার বান্ধবী তাকে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকতে দেখে। তাড়াতাড়ি ইমারজেন্সি সার্ভিস কল করা হয়। তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। লরাকে বাঁচানো যায়নি।
৭. লরাকে দেখার সময় আমি সহ যে দু’জন কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট জড়িত ছিলেন তাদের এখন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সেইসাথে আমাদের সঙ্গে যে সোশ্যাল ওয়ার্কার ছিল তাকেও বিশেষ আদালতে ডাকা হবে। যে হাসপাতালের হয়ে আমি কাজ করি সেই হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। ওখানে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা যা করেছিলাম তা ওই মুহূর্তে সঠিক ছিল। যদি সঠিক না হয়, আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা দক্ষতায় কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে আমাদের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।
৮. কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? বাংলাদেশের সঠিক হিসেব আমি জানিনা। তবে পশ্চিমা বিশ্বের হিসেবটা হচ্ছে এরকম- আত্মহত্যার শিকার শতকরা ৩০-৯০ জন বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনের ভুগে থাকেন, ৪৩-৫৪ জন অ্যালকোহল বা অন্যান্য মাদকে আসক্ত থাকেন, ৩-১০ জন স্কিজোফ্রেনিয়া অথবা Bipolar Mood Disorder রোগে ভুগে থাকেন, ২-৭ জন Organic Mental Disorder এবং ৫-৪৪ জন Personality Disorder-এ ভুগে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, একজন সুস্থ মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেন না। আত্মহত্যার পেছনে তার কোনো সাইকোলজিকাল ডিস্টার্বেনস (disturbance) থাকতেই হবে। উপরের যে হিসেবে দিলাম তার অধিকাংশকেই চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলা এবং বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এ কাজটা করবে কে? কেউ যদি এ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে তার পরিণতি কি তাকে ভোগ করতে হবে? সম্ভবত পরিণতি ভোগ করতে হবে না। কারো চাকরি যাবে না, লাইসেন্স স্থগিত হবে না, বদলিও হবে না, হাসপাতাল বা ওয়ার্ড বন্ধ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হাসপাতালে ডিরেক্টরকে তো এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেই যাবে না।
৯. বাংলাদেশে মোট কতজন লোক প্রতিবছর আত্মহত্যা করে? সরকারি হিসাব থাকলে থাকতেও পারে। তবে সেই হিসেবের চাইতে অনেক বেশি লোক আত্মহত্যা করে এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ২০১০ সালের একটি স্টাডি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুসারে ১৯,৬৯৬ জন লোক আত্মহত্যা করেন (অধ্যাপক ঝুনু শামসুন নাহার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ‘আত্মহত্যা বা সুইসাইড নিয়ে কিছু কথা’)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন ১০,২৫৬ জন। আরেকটি হিসেবে দেখা গেছে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন ১১ হাজারের মতো মানুষ (আসমাউল মুত্তাকিন, মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?)
১০. দু’দিন আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্নি ডাক্তার নশিন সাইয়ারা অদ্রি আত্মহত্যা করেছেন। এর আগেও অনেক ডাক্তার আত্মহত্যা করেছেন। নিরক্ষর মানুষের কথা বাদ দিলেও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত লোকজন কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর কেন আত্মহত্যা করলেন? মুনিয়া কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল? ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন যাদের মধ্যে ১১ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
১১. বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর আত্মহত্যার কারণ কী? ওদেরকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজ কী করেছে? দায়িত্বে অবহেলা করার কারণে কারো কি কোনো শাস্তি হয়েছে? ভুল থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে? ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলে পরবর্তী আত্মহত্যা বন্ধ করবেন কীভাবে?
১২. ধরুন, আপনি ঢাকার নামকরা এলাকা গুলশান, বনানী বা ধানমন্ডিতে থাকেন। নিরাপত্তার জন্য নিরাপত্তারক্ষী রেখেছেন। তিন শিফটে তিনজন নিরাপত্তাকর্মী আপনার বাসা পাহারা দেয়। সেই বাসায় চুরি হয়েছে। মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া গেছে। একবার নয়, কয়েকবার হয়েছে। আপনি এখন সেই নিরাপত্তাকর্মীদের কী করবেন? ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন? এতো বড় ঘটনা ঘটে গেল তখন তারা কী করছিল? দায়িত্বে অবহেলা পেলে আপনি কি তাদের চাকরি অব্যাহত রাখবেন না ছাঁটাই করবেন? অথবা অন্য কোন শাস্তি দেবেন?
১৩. ইংল্যান্ডের সমাজ ও সংস্কৃতিতে আমরা যারা বিভিন্ন পাবলিক সার্ভিসে (স্বাস্থ্য বিভাগে/পুলিশ) কাজ করি তাদের অন্যতম কাজ হচ্ছে সাধারণ জনগণকে বাড়ি বা হাসপাতালে নিরাপত্তা দেয়া, চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দেয়া এবং Preventable মৃত্যু থেকে রক্ষা করা। ঠিক বাংলাদেশের নিরাপত্তারক্ষীদের মতো। Coroner’s Court-এর কাজ হচ্ছে খুঁজে খুঁজে বের করা যে আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি কিনা। যদি পালন না করে থাকি তাহলে গুলশান বনানীর বাসার নিরাপত্তারক্ষীদের মতো আমাদেরও চাকরি থাকবে না, থাকলেও কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করবে।
১৪. যতদিন না বাংলাদেশে দায়িত্বের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না যাবে, ততদিন পর্যন্ত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ডাক্তার অদ্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর অথবা হাল আমলের প্রবল আলোচিত মুনিয়ার মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট
যুক্তরাজ্য