রাজধানীতে এলাকাভিত্তিক যেসব কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে তাদের তালিকা আপডেট করা হচ্ছে। বাহিনীগুলোর গডফাদার, টিম লিডার এবং সদস্যদের বিষয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিগগিরই রাজধানীজুড়ে এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে। পল্লবীতে চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি নিয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর রশিদ শুক্রবার এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে সুমন বাহিনীর ‘গডফাদার’ সাবেক এমপি এমএ আউয়ালসহ কয়েকজন গ্রেফতারের পর একে একে বেরিয়ে আসছে এ বাহিনীর নানা অপকর্ম। শুক্রবার ভোরে মিরপুরের রূপনগরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সুমন বাহিনীর সদস্য মানিক নিহত হয়েছে। সাহিনুদ্দিনের মৃত্যু নিশ্চিত করতে যে দুজন অন্তিম মুহূর্তে কোপাচ্ছিল তাদের একজন মানিক। অপরজন মনির। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে এ দুজনকে কোপাতে দেখা যায়। বাহিনী প্রধান সুমনসহ অন্তত ছয়জন এখন ডিবি হেফাজতে আছে। আউয়ালসহ তিনজনের ৪ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদিনের রিমান্ড শেষে দিপু নামের এক আসামিকে শুক্রবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে ডিবির ডিসি মানস কুমার পোদ্দার জানান, তার দেয়া তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাহিনুদ্দিন হত্যায় টিটু, ইকবাল ও মনিরসহ আরও বেশ কয়েকজন নজরদারিতে আছে। যে কোনো সময় তারা ধরা পড়বে। ১৬ মে পল্লবীতে ৭ বছরের শিশু সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সাহিনুদ্দিনকে প্রথম আঘাত করে সুমন বাহিনীর প্রধান সুমন। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মামলা করেন। মামলায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এবং তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এমএ আউয়ালসহ ২০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরও ১৪-১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। মামলায় এমএ আউয়াল ছাড়া আসামি হিসাবে অন্য যাদের নাম উল্লেখ করা হয় তারা হলো- আবু তাহের, সুমন, মুরাদ, মানিক, শফিক, টিটু, রাজ্জাক, শফিক (২), কামরুল, কিবরিয়া, দিপু, মরণ আলী, লিটন, আবুল, ন্যাটা সুমন, কালু ওরফে কালা বাবু, বাবু ওরফে বাইট্যা বাবু ও বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু।
স্থানীয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আউয়াল ছাড়াও স্থানীয় অড্ডু এবং বাপ্পির শেল্টারে থাকত সুমন বাহিনী। দুর্ধর্ষ সুমনের জন্ম কারওয়ান বাজার বস্তিতে। বাবা সবজি বিক্রেতা। অল্প বয়সে কিশোর সন্ত্রাসী হিসাবে যোগ দেয় মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাৎ গ্রুপে। কিশোর অপরাধী হিসাবে গ্রেফতারের পর তাকে বেশ কয়েকবার সংশোধন কেন্দ্রে পাঠায় পুলিশ। কয়েক বছর আগে পল্লবী থানা ছাত্রলীগ নেতা ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয়। ফুট-ফরমাশ খাটতে খাটতে ফরহাদের আস্থাভাজন হয়ে যায় সে। ফরহাদ সুমনকে বিভিন্ন নেতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে সুমন অল্প সময়ের জন্য ছাত্রলীগ মহানগর উত্তরের সহ-সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ছাত্রলীগ নেতা আলমগীর, যুবলীগ নেতা আশিক এবং আলীফ মোল্লার গ্রুপে কাজ করে। আলীফ মোল্লার সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে নিজেই একটি গ্রুপ তৈরি করে সুমন। নিজের নামে বাহিনী তৈরির পর তার এলাকায় চলাচলকারী অটোরিকশা আটক করে চাঁদা দাবি করে। এ সময় পল্লবীর অবৈধ অটোরিকশা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক আড্ডু তাকে কাছে টেনে নেয়। সেই থেকে আড্ডুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। আড্ডু স্থানীয়ভাবে খুবই প্রভাবশালী।
সূত্র জানায়, সাহিনুদ্দিনের ভাই মাঈনুদ্দিনের হাত ধরে ২০০২ সালে এমএ আউয়ালের প্রতিষ্ঠান হ্যাভেলি প্রপার্টিজ লিমিটেড মিরপুর-পল্লবী এলাকায় আসে। আউয়াল সেখানে আলিনগর আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। আলিনগর প্রকল্পের ইনচার্জ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় মাঈনুদ্দিনকে। মাইনুদ্দিন নিজের পৈতৃক সম্পত্তি হ্যাভেলির কাছে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে রাজি না হলে তাকে সরিয়ে পল্লবী থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মমিন বক্সকে আলিনগর প্রকল্পের ইনচার্জ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। মমিন বক্স দায়িত্ব নেয়ার পর তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মমিন বক্সের অপমৃত্যুর পর ৪ বছর আগে হ্যাভেলিতে যোগ দেয় সুমন। এরপর থেকেই সুমনের সঙ্গে সাহিনুদ্দিনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
সূত্র জানায়, ৫ বছর আগে পল্লবী থানা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর (উত্তর) শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন বাদলের ওপর হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসে সুমন। বছর দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধু কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাব্বিকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে সুমন। নারীরাও তার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। গত বছরের নভেম্বরে শান্তা নামে এক নারীকে কুপিয়ে আঙুল ফেলে দেয় সে। ওই মাসে পল্লবী এলাকায় কোপানো এবং হামলার ঘটনায় সুমনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়।
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত মানিক : সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার আসামি মানিক র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। শুক্রবার ভোরে মিরপুরের রূপনগরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মানিকের নামে থানায় একাধিক মামলা আছে। ৩ মাস আগেও ডাকাতির প্রস্তুতির মামলায় সে গ্রেফতার হয়েছিল। সে সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার ৫ নম্বর আসামি।
র্যাব-৪-এর পরিচালক মোজাম্মেল হক জানান, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে মিরপুরের পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী দলের অবস্থান জানতে পেরে র্যাবের টহল দল ওই এলাকায় যায়। তখন তারা অতর্কিত গুলি চালায়। র্যাবও গুলি ছোড়ে। ১০ মিনিটের মতো গোলাগুলি হয়। সেখান থেকে অন্যরা পালিয়ে গেলেও, একজনকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পুলিশ এসে নিহত মানিককে পল্লবীর হত্যা মামলার আসামি হিসাবে শনাক্ত করে। ময়নাতদন্তের জন্য মানিকের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়েছে। র্যাব জানায়, ঘটনাস্থল থেকে বিদেশি একটি পিস্তল ও দুই রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ঘটনাস্থল থেকে যারা পালিয়ে গেছে তাদের শনাক্ত করা যায়নি।
আউয়ালসহ তিনজন রিমান্ডে : সাবেক এমপি এমএ আউয়ালসহ তিনজনের ৪ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। শুক্রবার শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসী এ আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া অপর দুজন হলেন, জহিরুল ইসলাম বাবু ও নুর মোহাম্মদ হাসান। এদিন আসামিদের আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষে রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ রিমান্ড চেয়ে শুনানি করেন।