‘আমার বাবা ও বড় ভাই না থাকার কারণে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে মুখ বেঁধে ইচ্ছামতো মারধর করেছে। আমি এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না সে মাইরের ভয়ে। ইনশাআল্লাহ, আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আপনাদের জন্য দোয়া করে যাব। মহান আল্লাহ যেন আপনাদেরকে আমাদের মতো অসহায় নারীর পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেন।’
বরিশালের বানারীপাড়ার এক নির্যাতিত গৃহবধূ পুলিশের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা পেয়ে এভাবেই দোয়া করেন। শুধু গৃহবধূই নন, অসংখ্য অসহায় সেবাপ্রত্যাশীর মুখে হাসি ফোটাচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মিডিয়া উইং পরিচালিত ‘পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ।’ আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশকে একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তর করতে কাজ করছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।
সূত্রমতে, পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে কেউ অভিযোগ করলেই হলো, ব্যবস্থা নিতে দেরি করা হয় না। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে অনলাইনেই চলে বাদী, বিবাদী ও পুলিশের উপস্থিতিতে যাচাই-বাছাই। এরপর আইনি সহায়তা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এর পিছু ছাড়েন না নিয়োজিত কর্মকর্তারা। পেজটি ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, প্রতিদিন নীরবে এমন হাজারো কাজে মানুষের পাশে থাকছে পুলিশ। অথচ, ভাইরাল হচ্ছে দু-একজন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের গল্পই। এ নিয়ে হতাশাও কাজ করে পুলিশের মধ্যে। সম্প্রতি রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে দুইশ কিশোরকে আটক করার পর আলোচনায় আসে পুলিশের ফেসবুক পেজের নীরব কাজগুলো। গত দুই বছরে অসংখ্য মানবিক কাজ করেছে এ পেজ। এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মো. সোহেল রানা যোগদানের পর এটি গতি পায়। তার নির্দেশনায় অনেক সেবাপ্রত্যাশীর মুখে হাসি ফুটেছে।
সেবাপ্রত্যাশীর তালিকা দীর্ঘ : বরিশালের বানারীপাড়ার ওই গৃহবধূ বিয়ে করেন ইয়ার হোসেন নামের একই এলাকার এক ব্যক্তিকে। বিয়ের পর স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে তাকে ডিভোর্স দেন। স্বামী তা মেনে নিতে পারেনি। সুযোগ বুঝে একদিন বরিশাল জেলখানার মোড় থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। হাত-পা বেঁধে তাকে নিপীড়ন করে। নগ্ন ছবি ধারণ করে রাখে এবং তা দিয়ে তাকে হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে এ বিষয়টি জানিয়ে তিনি ‘বাংলাদেশ পুলিশ অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ’র ইনবক্সে সাহায্য চান। মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স উইং তার বার্তাটি পেয়ে বানারীপাড়া থানার ওসিকে নির্দেশনা দেয়। এরপর অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে গ্রেফতার করা হয় তার স্বামীকে।
ডিজিটাল পদ্ধতির সেবা : মৌলভীবাজার থেকে এক মেডিকেল শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, তার সঙ্গে ইমরান হোসেন নামের এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কের কিছু দিনের মধ্যেই তিনি জানতে পারেন ছেলেটি নেশাগ্রস্ত, স্বভাব-চরিত্রও ভালো নয়। জানার পর ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু ছেলেটি তাকে বিরক্ত করতে থাকে। একপর্যায়ে পরিবারের উদ্যোগে ছেলেটি বিদেশে চলে যায়। সেখান থেকে সে মেয়েটির নামে ফেক আইডি খুলে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও তৈরি করে তা মেয়েটির নিকটজনদের কাছে পাঠাতে থাকে। হুমকিও দেয়। মেয়েটির পরিবার এটি নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় ছিল। তারা ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সহযোগিতা পায়নি।
এমন তথ্য পেয়ে মিডিয়া উইং ওই ছাত্রীর পাশে দাঁড়ায় এবং তাকে পুলিশি সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। গাজীপুরের বাসন থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ করতে মেয়ের পরিবারকে মৌলভীবাজার থেকে গাজীপুর আসতে হতো। মেয়েটির বৃদ্ধ বাবার শারীরিক অবস্থা, করোনাকাল ও দূরত্ব বিবেচনা করে মিডিয়া উইংয়ের পরামর্শে অনলাইনে মেয়েটির পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ নেয় থানা পুলিশ। এর ভিত্তিতে ছেলের পরিবারকে থানায় ডাকা হয়। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির নিশ্চয়তায় একটি মুচলেকার ভিত্তিতে বিষয়?টির সমাধান হয়।
সাভার থেকে ২০ এপ্রিল ফেসবুক ইনবক্সে একজন জানান, সাভার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পাশে দীর্ঘদিন ধরে কিছু গাড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা পরিত্যক্ত গাড়িগুলোতে বসে আড্ডা দেয়। এদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। পাশে রাস্তা দিয়ে কোনো মেয়ে হেঁটে গেলে তারা অশালীন ভাষায় উত্ত্যক্ত করে। এছাড়া, গাড়িগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি করে তা বিক্রি করে ফেলছে। এসব কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকেই নাজেহাল হয়েছেন। বিষয়টি অবগত হওয়ার পরপরই সাভার মডেল থানার ওসি এএফএম সায়েদকে নির্দেশনা দেয় মিডিয়া উইং। এরপর ওই স্থান থেকে গাড়িগুলো নিরাপদে সরিয়ে ফেলে সাভার থানা পুলিশ।
কিশোর গ্যাং : লক্ষ্মীপুর থেকে ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায় বখাটে ও কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজনের তথ্য পাঠানো হয়। এরপর মিডিয়া উইং থেকে জেলা পুলিশ সুপারকে অবহিত করা হয়। পরে এসপির নির্দেশে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা হয়। পরে বিভিন্ন স্থানে সারা রাত অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের আটক করা হয়। এছাড়া রাজধানীর ফরিদাবাদ এলাকা থেকে আট কিশোর আটক এবং হাতিরঝিল থেকে দুইশ বখাটে যুবককে গ্রেফতার করা হয়।
খাবার পরিবেশনের জনপ্রিয় অনলাইন ফুডপান্ডার কর্মচারীকে মারধরকারীকেও গ্রেফতার করা হয় এ ফেসবুক পেজের সহায়তায়।
এছাড়া পাবনা থেকে জোরপূর্বক পাগল সাজানো এক ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ইব্রাহিম নামে নিঃস্ব অসুস্থ প্রবাসী আলোচিত এ ফেসবুক পেজের ইনবক্সে জানান, তিনি সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। দেশেও ফিরতে পারছেন না। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে তিনি পুলিশের সহযোগিতা চান। এরপর ইব্রাহিমকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়।
রাতের আঁধারে টঙ্গীতে শিশুর বুকে লাথি মারা লোককেও ছাড় দেয়নি ফেসবুক পেজ। তথ্য পাওয়ার পর সেই অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর টিউশনির টাকা আদায় হয়েছে পুলিশের মধ্যস্থতায়। পরকীয়ায় আসক্ত স্বামীকেও পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। অনলাইন সম্পর্কে জড়িয়ে নগ্ন ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগেও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়।