করোনাকালে বৃদ্ধাশ্রমে বাড়ছে আশ্রয়হীন বাবা-মায়ের সংখ্যা। যাদের অনেককে কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা থেকে। বৃদ্ধাশ্রমের বদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নিরবে ফেলছেন চোখের অশ্রু। তাদের অতীতের সুখ গল্পগুলো আঁকড়ে ধরে বুকে পাথর চেপে জীবন-যাপন করছেন এই অসহায় বাবা-মা। যাদের জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখকে বিসর্জন দিয়ে এসেছেন সন্তানের জন্য। সেই সন্তানদের ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও ভালো নেই বাবা-মা। বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব ভাবে জীবন কেটে যাচ্ছে তাদের। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের বুক ফেটে গেলেও পাচ্ছেন না তাদের কোন ছোঁয়া।
এই বাবা-মায়ের ঈদের আনন্দটাই যেন তাদের সন্তানবিহীন বৃদ্ধাশ্রমকে ঘিরে। অসহায় এই বাবা-মায়েরা নিজের অসহায়ত্বকে মেনে নিয়ে থাকতে চান জীবনের শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেকে সব অভিমান ভুলে গিয়ে ফিরে যেতে চান সন্তানদের কাছে। বৃদ্ধাশ্রমের কয়েকজন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের জীবনের কষ্ট-দু:খের কথা। তারই একজন সেলিম হোসেন (৭৫)। ৩২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তার দুই মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ৫ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে আছেন তিনি। এর মধ্যে একবারের জন্যও তাকে কেউ দেখতে আসেনি। অসুস্থ এই বৃদ্ধার চাওয়া মৃত্যুর আগে সন্তানদের একবার দেখা। সেলিম হোসেন বলেন, আমার মন পোড়ে। সন্তানরা আমার মৃত্যুর আগে একবার এসে দেখে যাক। একবারের জন্য আমি তাদের দেখতে চাই। আগে সন্তানদের নিয়ে ঈদ কত আনন্দে কাটতো। বাবা হয়ে এই দিনে তাদের সব চাওয়া পূরণ করেছি। আর আমার এখন বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ কাটাতে হবে। আফরোজা বেগম (৭২)। তিনি স্কুলে আয়ার চাকরি করতেন। দুই সন্তানের জননী তিনি। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানা চড়াও-উতরাও পাড়ি দিয়েছেন। চাকরির পাশাপাশি বাসাবাড়িতে রান্নার কাজও করতেন। এখন বয়সের ভাড়ে নানা রোগে ভুগছেন তিনি। যে বয়সে ছেলে-মেয়ের যত্ন-ভালোবাসা পাওয়ার কথা সে বয়সে তাকে থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি বলেন, ওরা কেউ আমাকে দেখতে আসে না। ওদের জন্য আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। অনেক কষ্ট হয়। এই কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না। ঈদের দিনগুলোতে তাদের আরও বেশি মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় পুরনো স্মৃতিগুলো। নিলুফার বেগম (৬৫)। নারায়ণগঞ্জ থেকে চিকিৎসার কথা বলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এসেছেন। তার চিকিৎসার কথা বলে হাসপাতালের ভিতরে ফেলে যান তার নারী ছেঁড়া আদরের সন্তানেরা। এখন জায়গা হয়েছে তার বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালের মাঝে। অভিমানের সুরে নিলুফার বলেন, বাড়িতে আর কোন দিন যাবো না। ছেলে-মেয়ে নিতে না আসলে। বছর ঘুরে এই ঈদের দিনে কতইনা আনন্দ হতো পরিবারের সঙ্গে। আমার নাতী-নাতনীদেরও খুব মনে পড়ছে। ওদের ছাড়া ঈদ আমার কিভাবে কাটবে? ঈদের দিন অনেক কষ্ট হবে। তোফায়েল হোসেন (৭০)। তাকে সন্তানেরা ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে উত্তরা ফ্লাইওভারের নিচে বসিয়ে রেখে যান। মালিবাগে তার নিজের বাড়ি আছে। তিনি বলেন, আমার ছেলে বলে আব্বা বসেন এখানে, আমি এসে নিয়ে যাবো। রাত যত হয় আমার ছেলের আর কোন খবর নেই। তারপর কিভাবে যেন আমার বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা হয়। এখন এখানেই ভালো আছি। শরিফা বেগম (৮০) কুমিল্লা থেকে ঢাকা অত্মীয়ের বাসায় নিয়ে আসে। ঢাকায় এসে তাকে ফেলে যায় রাস্তায়। স্থানীয় লোকজন বৃদ্ধাশ্রমে খবর দিলে তাদের লোকজন গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। এখন তিনি পরিবারের কথা ভুলে গেছেন। ভালো করে কোন কথা বলতে পারেন না। আরেক অসহায় বৃদ্ধ মা মমতা বেগম বয়সের ছাপে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন, হাজারবার বাবারে বাবারে করি, সারা দেয় না। কখনও মা বলে ডাকও দেয়না আমারে। এখন এই পরিবার নিয়েই আমার যত সুখ-শান্তি। মন ভেঙ্গে গেলেও এখানে এদের নিয়ে ঈদ করতে হবে। রাজধানীর কল্যাণপুর দক্ষিণ পাইকপাড়ার চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার মানবজমিনকে বলেন, করোনাকালে কুড়িয়ে আনা বাবা-মায়ের সংখ্যা বাড়ছে। গত ফ্রেবুয়ারি মাসে আট জনকে তুলেছি। মার্চে এসে আরও নয় জন। এখন মোট ১২৫ জন বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। এবং অসহায় প্রতিবন্দী এতিম শিশু আছে ১৮ জন। এখন প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে যাওয়ার খবর আসে। আমি শত কষ্ট হলেও এই বাবা-মাকে জায়গা করে দিই। রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধদের দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমি সারাজীবন এই অসহায় বাবা-মাকে আগলে রাখতে চাই। ঈদের দিনগুলোতে তাদের যতটুকু পারি হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবো। আমি তাদের সবাইকে আমার নিজের বাবা-মা মনে করি সবসময়। ঈদের দিনে তাদের নিয়েই যত আনন্দ আমার।