হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তির নেপথ্যে

Slider রাজনীতি


দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতিতে আলোচনায় হেফাজতে ইসলাম। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ফের আলোচনায় হেফাজত। এদিকে গত রোববার রাতে হুট করেই হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন সংগঠনটির আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। এর কয়েক ঘণ্টার পরেই ঘোষণা করা হয় পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি হঠাৎ বিলুপ্তি ও নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি এখন আলোচনায়। কেন হঠাৎ করে কমিটি ভেঙে দেয়া হলো। কাদের নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানবজমিন হেফাজতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে।
তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী হঠাৎ কমিটি গঠন ও সংগঠনটির পরবর্তী করণীয় বিষয়ে বেশকিছু উত্তর মিলেছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন কমাতেই হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তি করা হয়েছে বলে সংগঠনটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অনেকে বলছেন, হেফাজতে ইসলামের নেতারা বক্তৃতায় সরকারবিরোধী কথাবার্তা বললেও সাম্প্রতিক ধরপাকড়ে বেকায়দায় পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়াই তাদের এই মুহূর্তের লক্ষ্য। এজন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। কৌশলের অংশ হিসেবে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সংগঠনের তরফে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠক এবং ওই বৈঠকে দেয়া কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নেয়া পদক্ষেপে সংগঠনের একাংশের আপত্তি থাকলেও শীর্ষ নেতারা বলছেন, এটি সংগঠনের স্বার্থেই করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের এক কেন্দ্রীয় নেতা মানবজমিনকে জানান, মূলত তিনটি কারণে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে। প্রথমত গ্রেপ্তার, মামলা ও ধরপাকড় এড়াতে। দ্বিতীয়ত চাপে পড়ে অনেক নেতা পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। দলে ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে কমিটি বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। তৃতীয়ত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনা করেই মূলত এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণার আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিন ওই মাদ্রাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নজরদারি ছিল।

গত রোববার রাতে হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তি করে সংগঠনটির আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির কারণে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে সংগঠনটির মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী মানবজমিনকে বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। পরে ৫ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা কিছুদিনের মধ্যে এই আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়াবো।

৫ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা হলেন- আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, উপদেষ্টা আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী, মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী, সদস্য মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর কেন্দ্র করে হেফাজতের বিক্ষোভে সহিংস ঘটনায় ১৮ জন নিহত হন। এর পর সারা দেশে হেফাজত নেতাদের নামে মামলা হয়। ধরপাকড় শুরু হয় দেশব্যাপী। এ পর্যন্ত হেফাজতের সদ্য বিলুপ্ত হওয়া কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির অন্তত দুই ডজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সংগঠনটির বিলুপ্ত কমিটির শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা আহমদ আবদুল কাদের, জুনায়েদ আল হাবীব ও মামুনুল হক। যুগ্ম মহাসচিব-সহকারী মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সম্পাদকীয় পর্যায়ের বহু নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। দেশব্যাপী হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে সংগঠনটির অভিযোগ। গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার ও ধরপাকড় থেকে নেতাদের বাঁচাতে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। গত সপ্তাহে হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসভবনে বৈঠক করেন। ওই প্রতিনিধি দলে মামুনুল হকের ভাই মাহফুজুল হকও ছিলেন। তারা গ্রেপ্তার বন্ধের দাবি করেন। সেই সঙ্গে সহিংস কোনো কর্মসূচিতে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বৈঠকের পরেও সারা দেশে হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকে। এরই প্রেক্ষিতে গত রোববারও হেফাজত নেতাদের সঙ্গে সরকারের ঢাকায় একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। যদিও পরে এই বৈঠক হয়নি। এমতাবস্থায় হেফাজতের শীর্ষ নেতারা কমিটি ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাতে নেতাদের গ্রেপ্তার থেকে বাঁচাতে পারেন।

এদিকে সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানায় হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। এ দুই মামলায় ১৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মামলাগুলো হয়।

এদিকে ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ায় হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন নেতা। গত ১১ই এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু হওয়ার পর পর্যন্ত চারজনের সংগঠন ত্যাগের খবর পাওয়া গেছে। ১৩ই এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীরের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি ও বাহাদুরপুরের পীর মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। এরআগে মাওলানা বাবুনগরীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন আরেক নায়েবে আমীর লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার সদরে মুদাররিস মাওলানা হাবিবুর রহমান। ২২শে এপ্রিল হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা নাছির উদ্দিন। গত ২৩শে এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুফতি আব্দুর রহিম কাসেমী।

জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি করার কোনো বৈধতা রাখেন না বলে অভিযোগ করেছেন হেফাজতের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমরা আগেই বলেছি বাবুনগরী হেফাজতের মূলধারায় নেই। তারা অবৈধভাবে কমিটি করেছিল। সেটা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। মূলধারার হেফাজতে আমরা আছি। এখন তারা যদি আহমদ শফীর আদর্শ মেনে ফিরে আসেন, তাদের আমরা স্বাগত জানাবো। আমরা তাদের সঙ্গে যাব না।

শফীপন্থিদের নতুন কমিটি গঠনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেটা এখন কোন্‌ পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, আমরা নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেইনি। কারণ, কমিটি তো আল্লামা শফী গঠন করেই গেছেন। আমরা সেটার মধ্যে কিছু সংস্কার করবো। সেখানে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করবো।

তাহলে নতুন কমিটিতে কে আমীর হবেন?- জানতে চাইলে রুহী বলেন, এটা গঠনতন্ত্র মোতাবেক হবে। তিনি (আহমদ শফী) যখন মারা গেছেন একজন আমীর নির্বাচিত হবেন। বাকি কমিটির সবাই বহাল আছেন। কমিটির যারা মারা গেছেন সেখানে নতুন করে সংযোজন হবে।

ওই কমিটির মহাসচিব হিসেবে জুনায়েদ বাবুনগরীর আমীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে রুহী বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি যদি তাকে আমীর হিসেবে চায়, সবাই যদি মত দেয় তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
প্রসঙ্গত, আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পরে ২০২০ সালের ১৫ই নভেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমীর ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলামের ১৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ১৩ই ডিসেম্বর মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী মারা গেলে নায়েবে আমীর মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *