শ্বাস নিতে পারাই এখন বিলাসিতা। আঁতকে উঠার মতো শিরোনাম। কিন্তু ভারতে এটাই এখন বাস্তবতা। এ যেন করোনার সুনামি। চিতায় দীর্ঘ লাইন। বাতাসে লাশের গন্ধ। দিনে সংক্রমণ ছাড়িয়েছে সাড়ে তিন লাখ। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে দুই হাজারের বেশি মানুষ।
বাড়ির পাশে মহাবিপর্যয়।
বাংলাদেশেও থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। মৃত্যু প্রায়দিনই একশ’ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। লকডাউনের পর সংক্রমণ অবশ্য কিছুটা কমেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাস্তবে তা কতোটা কার্যকর হবে কে জানে? বেনাপোল বন্দর দিয়ে গত ১০ দিনে ভারত থেকে এসেছেন ৩৮০১ জন। তাদের মধ্যে পরীক্ষা করে ১২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। কোয়ারেন্টিন থেকে এরই মধ্যে পালিয়ে গেছেন ১০ করোনা রোগী। বাকিরা বাড়িতে কী ধরনের কোয়ারেন্টিন পালন করছেন তা সহজেই অনুমেয়।
ভারতে এই যখন অবস্থা তখন বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হতে চলেছে। লকডাউন চলছে। কিন্তু রাস্তায় রীতিমতো যানজট। শপিং মল, দোকানপাট এরইমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে। শপিং মলে লোকজনের ভিড়ের ছবি এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধির প্রতি এখনো রীতিমতো উদাসীন মানুষ। মানাতেও তেমন কোনো কঠোরতা নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন বারবার। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এগুতে চেয়েছিল ভারত। নির্বাচন আর জনসমাগম কোনো কিছুই বন্ধ করেনি। এর মূল্য দিতে হচ্ছে জীবনের বিনিময়ে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেশ উন্নত। কিন্তু ভয়াল করোনার ধাক্কায় সে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দেশে চলমান লকডাউন আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হচ্ছে। ৫ই মে পর্যন্ত বিধিনিষেধ চলবে। মেয়াদ বাড়লেও মানুষ বিধিনিষেধ কতোটা মানবে- এটাই এখন দেখার বিষয়।
লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, টিকা। করোনা মোকাবিলায় দেশে দেশে চলছে নানা প্রচেষ্টা। বাংলাদেশ টিকা দানের শুরুতে সাফল্য দেখালেও ইতিমধ্যে তা হোঁচট খেয়েছে। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট অগ্রিম অর্থ নিয়েও সময়মতো টিকা পাঠাচ্ছে না। যে কারণে প্রথম ডোজ টিকা দান এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার বিকল্প নানা উৎস থেকে টিকা আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু কবে পুরোদমে টিকাদান শুরু করা যাবে বলা মুশকিল। করোনা মোকাবিলায় শুরু থেকেই প্রশাসনকে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সামনের কাতারে দেখা গেছে কম সময়ই। সর্বশেষ বিদেশ ফেরতদের মাত্র তিনদিন কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনদিনের কোয়ারেন্টিন বলতে কিছু নেই। ১৪ দিনের নিচে কোয়ারেন্টিন হয় না।
সম্পূর্ণ লকডাউন দেশে কখনোই সেভাবে কার্যকর করা যায়নি। জীবন বনাম জীবিকা, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই। এবারেও লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। জীবিকার তাগিদে অনেকেই ঘর থেকে বের হয়েছেন। আবার অনেকের মাঝে ছিল খামখেয়ালি। এই পরিস্থিতিতে সরকার এরইমধ্যে লকডাউন মোটামুটি শিথিল করে দিয়েছে। আগামী ২৯শে এপ্রিল থেকে আরো বিধিনিষেধ উঠে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব সিদ্ধান্ত কি করোনা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করবে? আমরা কি ফের ভুল পথে হাঁটছি?
করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউ’র সাবেক ভিসি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এক্ষেত্রে টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না করতে পারলে আমরা আবারো মার খেয়ে (ব্যর্থ) যাবো। যেটা ইতিমধ্যে সেকেন্ড ওয়েভে ফেস করেছি। এবং এতে করে অনেক রোগী মারা গেছে। আমরা দেখেছি যে, রোগী মারা যাচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না, রোগীর স্বজনরা কান্না করছে। এটা হয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংস্থার স্বভাবসুলভ গাফিলতির কারণে। এখন আরেকটি রেসপনসিবলিটি দোকান মালিকদের ওপর। তারা কিন্তু দোকান খোলার প্রথম দিনই স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে অনেকটা উন্নতি দেখিয়েছে। এখন যদি আমরা এটা ধরে রাখতে পারি তাহলে অনায়াসে দোকান-শপিং মল খোলা রাখা যাবে। এবং এই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা ১২ মাস খোলা রাখতে পারবো। এবং তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা কিন্তু হবে না।
তিনি বলেন, এই যে আমরা কঠোর লকডাউন দিলাম। এতে যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তারা ভুক্তভোগী হয়েছে। তাদের বাচ্চারা খেতে পায়নি। মানবসভ্যতা অনেক এগিয়েছে। এখন কিন্তু সকলে মিলেই অনেক ভালো থাকতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে দোকান মালিক সমিতির ওপর। তারা খুব ভালো কাজ করেছে। এবং এই কাজটি আরো ভালোভাবে করতে হবে। শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শতভাগ মানে শতভাগ, ৯৯ ভাগ নয়। এটা বলে দিতে হবে। তাদেরকে আরেকটি বিষয় বোঝাতে হবে মাস্ক পরলে একজন মানুষ যদি সংক্রমিত হয় তার থেকে ভাইরাসটি ছড়াবে। যেটা আরেকজন ব্যক্তি যিনি তাকে সংক্রমিত করবে। এক্ষেত্রে কিন্তু ভাইরাসটিকে দুটো মাস্ক ক্রস করে যেতে হচ্ছে। একজন মাস্ক পরা মানে ভাইরাসকে দুটো মাস্ক ট্রাভেল করতে হচ্ছে। এটা যেন সবাই মনে রাখেন।
আমরা বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আমাদের জাতীয় করোনাভাইরাস ম্যানেজমেন্টের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি। গত বছর সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময় মানুষ মাস্ক পরতো না। দু’একজন হয়তো পরতো। তখন এটার অনেক প্রতিফলন হয়েছে। এরপর গত বছরের মে থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণ হার ছিল ২০ ভাগ। এরপর কিন্তু কমতে শুরু করে। গত ফেব্রুয়ারিতে একেবারে কমে ২ ভাগের নিচে চলে এসেছে। এই যে সংক্রমণ কমেছে তখন আমাদের ম্যানেজাররা বলেছে আমরা করোনা জয় করেছি। কিন্তু তারা বুঝেনি এটা কমার কারণ কি? তারা তো যা ইচ্ছা তাই বলে। তারা সাহিত্যিক-রাজনৈতিক ভাষায় মাঝে মধ্যে বলেছে আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। তারা করোনার সঙ্গে কুস্তি লড়েছেন কিনা জানি না!
প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, এই যে আমরা বুঝলাম না কেন কমেছে। এরপরে আবার করোনা শনাক্ত বাড়তে শুরু করেছে। তখন আমরা বলেছি সেকেন্ড ওয়েভ এসেছে। মানুষ মাস্ক পরে না। গাদাগাদি করে বাজার করতে যায়। গণজমায়েত, ইত্যাদি বন্ধ করার চেষ্টা করিনি। এরপর বলা হলো লকডাউন। কিন্তু এবার সেকেন্ড ওয়েভে একটি বিষয় হলো আমাদের মৃত্যু হার বেড়ে গেল। যেটা প্রথম ওয়েভে ছিল না। তখন আমাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করতে অনেক অব্যবস্থাপনা ফ্লো করেছে। আমাদের এখানে নন-কোভিডদের কোনো ব্যবস্থা রাখিনি। আমরা কিন্তু কোভিড নিয়েই ব্যস্ত। তখন টোটাল ইনফেকশন কিন্তু বাড়েনি। শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার কমে গেছে। আমাদের ম্যানেজাররা বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করেছে করোনা শেষ হয়ে গেছে। যে ক’টি কোভিড হাসপাতাল করেছে তার ডেভেলপমেন্ট করার উদ্যোগ কমিয়ে দেয়। তখন তাদের উচিত ছিল এগুলো রেখে দেয়া। তারা (ম্যানেজমেন্ট) খুব খারাপভাবে কতোগুলো কৈফিয়ত দেয়। যেটার বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনেকটা ধান-চালের বেপারীদের মতো।
ইতিমধ্যে গত বছরের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন দেশের সবগুলো জেলা হাসপাতালে আইসিইউ’র ব্যবস্থা করা হবে। এ সময় মোট ২৮টি জেলায় হলেও বাকি ৩৬টি জেলাতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কিন্তু মানা হলো না। এটা কিন্তু ম্যানেজমেন্টের বিরাট একটি পরিবর্তন। এর আগে আমরা দেখেছি অন্তত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানা হতো। এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। ৭৯ সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের মধ্যে ২৯টি প্রজেক্ট সম্পন্ন হলেও ৫০টি হয়নি। এই হলো আমাদের কাজের নমুনা। এরকম পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দ্বিতীয় ঢেউ ফেস করতে গিয়েছি। অর্থাৎ, সেকেন্ড ওয়েভ আমাদের এই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে চেষ্টা করলাম। এতে করে যে সব জেলাতে আইসিইউ’র ব্যবস্থা নেই সেই রোগীগুলোকে ঢাকায় পাঠানো হলো। আমাদের রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ফলে আমাদের মৃত্যু হার বেড়ে গেল। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা যদি হাজার হাজার আইসিইউ বেড তৈরি করি তারপরেও সব রোগীকে স্থান দিতে পারবো না। এর পরের টুকু বলেননি। কিন্তু তারপরের কথাটা হওয়া উচিত ছিল ‘সেজন্যই আমরা করিনি’। সাবেক এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, মৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে শনাক্ত যদি বেশি হয় এবং সকল হাসপাতালগুলোতে কেস ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতাই নেই। ফলে অনেক রোগী হাসপাতালের বাইরে মারা গেছে। কোথায় বেড, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাইফো ন্যাজাল খালি আছে সেই তথ্যগুলো মানুষকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। এটা ম্যানেজমেন্টের ঘাটতি। যদি ফোন করে জানা যেত কোন্ হাসপাতালে কয়টি আইসিইউ, বেড খালি আছে তাহলে এই ঘোরাঘুরি করতে হতো না। অনেক রোগী রাস্তায় মারা গেছে যার খোঁজই পাইনি আমরা। আমরা দেখি ১০২ জন মারা গেছেন। ১০২ জন নয় অনেক বেশি মারা গেছে। এই হলো আমাদের অবস্থা। তার মানে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চরম অবহেলা করেছি। এবং এটার জন্য অনেক রোগী মারা গেছে।