মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির সেই উত্তাল দিনে শানিত কণ্ঠে গণসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল লতিফ, গেয়েছিলেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’! এই কালজয়ী গান এখনো মানুষের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ছাত্রদের প্রবল প্রত্যাশার মুখে ক্ষমতালিপ্সু পাকিস্তানিদের হিসাব-নিকাশের রাজনীতি উড়ে গিয়েছিল সেদিন। রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা পেয়েছিল মাতৃভাষা বাংলাকে। এ কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির চির প্রেরণার প্রতীক।
সত্যি বেফাঁস কথা বলে মহা সমস্যার ফাঁদে পড়েন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক এ প্রসঙ্গে লেখেন, তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, চার বছর আগে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ভাষা আন্দোলন তাকে কী সংকটেই না ফেলে দিয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে পরিস্থিতির দায় থেকে মুক্তি, তবে পূর্ণ মুক্তি ঘটেছিল তাদের ‘কায়েদে আজম’-এর কল্যাণে। তিনি আট দফা চুক্তি খারিজ করে দিয়ে খাজা সাহেবকে বন্ধনমুক্ত করেছিলেন। সে ঋণ ভুলে যাবার নয়। এবারও তিনি পরিস্থিতি বুঝে পূর্ব পরিত্রাতার দিকেই হাত বাড়িয়ে দেন।
ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে তিনি গভর্নমেন্ট হাউসে ৩ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন মূলত রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে তার বক্তব্য ও অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য। তিনি জানান, পল্টন ময়দানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে যা বলেছেন তা সবই কায়েদে আজমের কথা, তার নিজের কথা নয়। এরপরও তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রাদেশিকতার বিপদ ইত্যাদি নিয়ে তাদের বহুকথিত বক্তব্যই তুলে ধরেন। আসলে রাজনৈতিক জীবনের গোটা সময়টাতে তিনি ছিলেন কায়েদের ভক্ত, কায়েদের অনুসারী। আর সেজন্য কায়েদও তাকে সোহরাওয়ার্দীর চেয়েও বিশ্বস্ত ভক্ত হিসেবে কাছে টেনেছেন।
শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক তার সব বক্তব্যের দায় কায়েদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের এমন কথাও বলেন যে, তিনি কায়েদের নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার মাত্র গণপরিষদেরই রয়েছে। ব্যস, সব চুকে-বুকে গেল। এমন ধারণা নিয়ে তিনি পরদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু বুঝতে পারেননি যে, গত কয়েক বছরে জমা ক্ষোভের শুকনো বারুদ স্ফুলিঙ্গপাত ঘটিয়ে গেছেন তিনি।
কারণ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে জিন্নাহ সাহেব (কায়েদে আজম) বাঙালি তরুণদের বাংলা বিষয়ক যে আবেগের ওপর পানি ঢেলে দিয়ে গিয়েছিলেন, তা গত কয়েক বছরে শুকিয়ে ক্ষুব্ধ বারুদের চরিত্র অর্জন করে। সেটা আরো এ জন্য যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার নানাভাবে বাংলাভাষার ওপর আঘাত করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা। এ প্রচেষ্টার মূলনায়ক কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গে উর্দু শিক্ষার প্রসার ঘটানোরও চেষ্টা চলেছে।
জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা সত্ত্বেও ছাত্রদের একাংশ হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকেননি। যে-যার মত কাজ করে গেছেন। পরিস্থিতি এভাবেই বাংলা ভাষার পক্ষে পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
এটা স্পষ্ট ছিল যে, ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ডাকা খাজা নাজিমুদ্দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য কোনোভাবেই ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।