দেশের অধস্তন বিশেষ আদালতগুলোতে প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে গণবদলি। গত ১০ দিনে হাইকোর্টের বিচার শাখা থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ১১২ কর্মচারীকে। এর মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি একদিনেই বদলির আদেশ পান ৮২ জন। হঠাৎ করেই সরকারে এমন উদ্যোগে অধস্তন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে বদলি আতঙ্ক। আইনজীবীরা অবশ্য এটাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, এমন উদ্যোগে দুর্নীতি কমবে আদালত অঙ্গনে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এখন বদলিভীতি কাজ করবে। তবে আদালতের দুর্নীতি কমাতে হলে কর্মচারীদের নিয়মিত বদলি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের মনিটরিংও (তদারকি) বাড়াতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাদের বদলি করা হয়েছে তারা চাকরি পাওয়ার পর থেকে একই কর্মস্থলে কাজ করছিলেন। অনেকে একই কর্মস্থলে ছিলেন ২০-২৫ বছর ধরে। বদলিকৃতদের সবাই অবশ্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের মতো বিশেষ আদালতগুলোয় কর্মরত ছিলেন। কাজ করেন বেঞ্চ সহকারী, রেকর্ড সহকারী এবং স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। তাদের বদলির পেছনে দুর্নীতি-অনিয়মের সিন্ডিকেট গড়াসহ নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনিক কারণেই এ বদলি।
সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে আমাদের সময়কে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী অধস্তন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব হাইকোর্ট বিভাগের হাতে। বর্তমানে এই দায়িত্ব পালন করেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. সহিদুল করিম। সম্প্রতি কিছু অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের গণবদলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহানগর দায়রা জজ আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচরারীকে কিন্তু এখন বদলি করা হয়নি। কারণ যে কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেই সাধারণত এসব আদালতে বদলি করা হয়। কিন্তু বিশেষ আদালতগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ধারণা ছিল যে, তাদের নিয়োগ হওয়ার পর আর বদলির সুযোগ নেই। আগে কখনো তাদের বদলিও করা হয়নি। ফলে তারা এক ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে সম্প্রতি আড়াই-তিন বছরের ঊর্ধ্বে একই কর্মস্থলে কাজ করছেন এমন সবাইকেই বদলি করা হচ্ছে। সামনে আরও বদলি করা হবে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকার একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের খাসকামরায় ১ লাখ টাকা রেখে দেন তার স্টেনোগ্রাফার। একটি মামলায় অনৈতিক সুবিধা নিতে তিনি এটি করেছিলেন। পরে বিচারক বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকে অবগত করেন। এ ছাড়া ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে একটি ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কারণ দর্শানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব না দেওয়ায় ওই ট্রাইব্যুনালের বিচারক গত ১ মার্চ মামলা করার সিদ্ধান্ত দেন। সে অনুযায়ী ওই আদালতের জারিকারক কবির হোসেন রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। মামলার পরই সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী মো. সামছুদ্দিন ও সেরেস্তা সহকারী সেলিমেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এসব আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
বদলির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী খান হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সব সরকারি সেক্টরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিতে দুই-তিন বছর পর পর বদলি হতে দেখি। কিন্তু বিচার বিভাগে সাধারণত চাকরি যেখানে সেখান থেকেই অবসর। এ কারণেই আমরা বিচার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দুর্নীতির চিত্র দেখতে পাই। আমি মনে করি, বদলির উদ্যোগ একটি ভালো পদক্ষেপ। এটা বিচার বিভাগে দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হবে। তবে সঙ্গে মনিটরিংও জোরদার করতে হবে।’
নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের সাবেক স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমি যখন প্রসিকিউটর ছিলাম, তখন মন্ত্রণালয়ে মিটিংয়ে পেশকার-পিয়নদের বদলি করার কথা বলতাম। কারণ দেখা গেছে, তারা আদালতের প্রসেস সমন, ওয়ারেন্ট ঠিকমতো পাঠায় না। বদলির ভয় না থাকায় আইনজীবীদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে। হাইকোর্ট ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। একজন জজ তিন বছরের বেশি এক জায়গায় থাকতে পারেন না, সেখানে পেশকার-পিয়ন কেন বদলি হবে না? বদলির ভয় থাকলে তারা দুর্নীতিও কম করবে। বিচারকদের প্রভাবিত করতে পারবে না।’