পুলিশের অভিযোগপত্রে ছয় সাক্ষীর নাম সাক্ষ্য দেননি বলে ৫ জনের অস্বীকার

Slider বাংলার আদালত


ঢাকাঃ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আসামিরা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়িয়েছেন। আর অনলাইনে তাঁদের এসব কর্মকা-ের সাক্ষী করা হয়েছে বাসা, মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী, পিয়ন, আত্মীয়সহ ছয়জন সাধারণ নাগরিককে। অভিযুক্ত তিন ব্যক্তি কী ধরনের মুঠোফোন ব্যবহার করতেন, কোন কোন নামে তাঁদের ফেসবুক আইডি আছে এবং কোন পেজ থেকে ষড়যন্ত্রমূলক পোস্ট দিয়েছেন বা অনলাইনে নিজেদের মধ্যে কী কথা বলতেন, তা-ও এই সাক্ষীরা জানতেন। গত মাসে আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা গেছে। যদিও এই ছয় সাক্ষীর পাঁচজনই সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো সাক্ষ্য তাঁরা পুলিশকে দেননি।
গত বছরের মে মাসে কিশোর, মুশতাক ও দিদারুলকে লালমাটিয়া ও কাকরাইল এলাকার নিজ নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর তাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। এর মধ্যে কারাবন্দী মুশতাক গত রাতে মারা গেছেন।

দিদারুল জামিনে ও কিশোর কারাগারে আছেন।
ওই মামলায় পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্র অনুযায়ী, র‌্যাব, পুলিশ ও সিআইডির সদস্য ছাড়াও ছয়জন সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। তাঁদের তিনজন বাড়ি ও বিপণিবিতানের নিরাপত্তারক্ষী ও একজন পিয়ন, একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি ও একজন চিকিৎসক। কার্টুনিস্ট কিশোর কাকরাইলের ১২২/১ নম্বর বাসায় থাকতেন। সাক্ষী ছয়জনের তিনজন কাকরাইলের এই বাসা ও এর আশপাশে থাকেন। আরও যে তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকেরই বর্তমান ঠিকানা লালমাটিয়ার ‘পরম্পরায়’ নামের একটি বাড়ি। এখানে থাকেন লেখক মুশতাক আহমেদ। এই ছয় সাক্ষীর একজন হলেন মো. হাবিবুর রহমান। তিনি কিশোর যে বাসায় থাকতেন, তার পাশের ভবনের পিয়ন। আরেক সাক্ষী মো. সালাউদ্দীন বিশ্বাস ওই ভবনের পাঁচতলায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসে থাকতেন এবং সাক্ষী মো. আবদুল হাকিম পাশের মৌবন মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী।

হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ঘটনার (কিশোর আটক হওয়া) অনেক দিন পর পুলিশ এসেছিল। আমার কাছে জানতে চাইল পাশের ভবনে র‌্যাব একটা অভিযান করেছিল, আমি জানি কি না। আমি বললাম, হ্যাঁ, শুনেছি। কী কারণে অভিযান হয়েছে, কিছুই আমি জানি না। আমি কোনো কাগজপত্রেও সই করিনি।’
নিরাপত্তারক্ষী মো. আবদুল হাকিম বলেন, ‘একদিন দুপুরে র‌্যাব-পুলিশ আইসা কইল, একটু আসেন। আপনার একটা সাইন লাগবে। এর অনেক দিন পর মহসীন সর্দার নামে একজন পুলিশ আইসা আমাদের তিনজনকে এক জায়গায় নিয়া গেল। সেই জায়গায় আবার লুঙ্গি পইরা এবং মাস্ক ছাড়া ঢোকা যায় না। এরপর একটা কাগজরে তিনটা ফটোকপি কইরা বলছে সাইন দিতে, আমরা দিলাম।’ তিনি আহমেদ কবীর কিশোরকে চেনেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ওই দিনই তিনি কিশোরকে প্রথম দেখেন।
অন্য যে তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছে, তাঁরা লালমাটিয়ার মুশতাকের বাসার নিরাপত্তারক্ষী মো. চান মিয়া (৩৫), মো. জব্বার খান (৬২) ও মুশতাকের আত্মীয় চিকিৎসক রিয়াসাত আলম (৪৭)। এই তিনজনই বলেছেন, তাঁরা কোনো জবানবন্দি দেননি। যে রাতে মুশতাক আহমেদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই রাতে তাঁর মুঠোফোন ও ডিজিটাল ডিভাইস নেয়া হয়েছিল। র‌্যাবের কথামতো তাঁরা শুধু জব্দ তালিকায় সই করেছেন।
মুশতাক ফেসবুকে কী লিখতেন, কাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক কথা বলেছেন- সেটা জানতেন কি না? এ প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তারক্ষী মো. জব্বার খান বলেন, ‘হেরা হইল গিয়া মালিক। আমি দারোয়ান। তারা কী করে, আমি ক্যামনে জানমু?’ তিনি জানান, ফেসবুক কী, তা তিনি জানেন না।
সব সাক্ষীর সাক্ষ্য এক হয়ে যাওয়ার অর্থ তদন্তকারী কর্মকর্তা খুব একটা পরিশ্রম করতে চাননি। আবার এমনও হতে পারে যে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সাক্ষ্য আলাদা হলে মামলা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ছয় সাধারণ নাগরিকের মধ্যে পাঁচজনের এবং র‌্যাবের একজন কনস্টেবলের নামে যে সাক্ষ্য রয়েছে, সেটার বক্তব্য দাঁড়ি-কমাসহ হুবহু এক।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, সব সাক্ষীর সাক্ষ্য এক হয়ে যাওয়ার অর্থ তদন্তকারী কর্মকর্তা খুব একটা পরিশ্রম করতে চাননি। আবার এমনও হতে পারে যে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সাক্ষ্য আলাদা হলে মামলা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত সুষ্ঠু হওয়া প্রয়োজন ন্যায়বিচারের স্বার্থে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক কথা আছে। সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার সতর্কতা অবশ্যই প্রয়োজন, যেন কোনো প্রশ্নের উদয় না হয়।
মামলা হয় ১১ জনের নামে
গত বছরের ৬ই মে র‌্যাব রমনা থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫-৬ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করে। মামলায় বলা হয়, ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’ ফেসবুক পেজ থেকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণœ করা বা বিভ্রান্তি ছড়ানো বা এ উদ্দেশ্যে জেনেশুনে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ পেজের অ্যাডমিন সায়ের জুলকারনাইন, আমি কিশোর, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ ও মুশতাক আহমেদ।
উল্লেখ্য, সায়ের জুলকারনাইন সম্প্রতি আল-জাজিরায় প্রচারিত তথ্যচিত্র ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’-এর সামি বলে জানা গেছে।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার উপপরিদর্শক মহসীন সর্দার গত ১১ই জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই মামলায় কার্টুনিস্ট কিশোর, লেখক মুশতাক ও রাষ্ট্রচিন্তাকর্মী দিদারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন। একই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান অব্যাহতি পান। দিদারুল জামিনে আছেন। অন্যদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় এ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।

অবশ্য পরে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন এটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম।
কার্টুনিস্ট কিশোরের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কিশোররা ফরমায়েশি মামলার আসামি হয়েছেন। পুরো তদন্ত কার্যক্রম ১০৫ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এ মামলায় পুলিশ ট্রাইব্যুনালের কাছে তদন্তের সময়সীমা বাড়ানোর কোনো আবেদন করেনি। তারা খেয়ালখুশিমতো কাজ করেছে।
তবে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, মামলাটি ফরমায়েশি নয়। বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে এ মামলা করা হয়েছে এবং এজাহারে প্রয়োজনীয় সব তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়েছে।
লেখক মুশতাক বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে যে কথাবার্তা বলেছেন, তার একটি সিডি তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছে সিআইডি। ওই কথোপকথনকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলছে র‌্যাব-পুলিশ। তবে এতে কী বলা হয়েছে, তা অভিযোগপত্রে বলা হয়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা মহসীন সর্দার বলেন, মুশতাক অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বানচাল করার কথা বলেছেন।

সবার সাক্ষ্য কী করে মিলে গেল? বাসার নিরাপত্তারক্ষী কী করে জানবেন বাসিন্দারা কোন ফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের ফেসবুক আইডি কী এবং কার সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক কথা বলছেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মহসীন বলেন, ‘আপনি কি আমাকে জেরা করছেন? এটা আপনার ইস্যু না।’
আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া আলামত সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে ছিল স্যামসাং, শাওমি ও কিংস্টার মোবাইল ফোন, একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক, ২০০টি সিডি ক্যাসেট, অ্যাপলের ম্যাক মিনি সিপিইউ এবং ২৪ পাতার স্ক্রিনশট।
সিআইডির আইটি ফরেনসিক ল্যাবের পুলিশ পরিদর্শক কে এম নাহিদ হোসেন এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে লেখেন, ফরেনসিক ল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্যামসাং-কিংস্টার মোবাইল ফোন, হার্ডডিস্ক, সিপিইউ ও ২০০ সিডি ক্যাসেট ‘ম্যানুয়ালি’ বিশ্লেষণ করে এ মামলাসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শাওমি মুঠোফোনে মুশতাক আহমেদের কয়েকটি পোস্ট এবং ফেসবুকে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র পাওয়া যায়। তবে এতে স্ক্রিনশটগুলোর মতো কোনো পোস্ট পাওয়া যায়নি।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯-এর আঞ্চলিক প্রধান ফারুখ ফয়সাল বলেন, কিশোর, মুশতাক ও দিদার অন্যায় কিছু বলেননি। তাঁরা কাউকে হুমকি দেননি। তাঁরা শুধু স্ট্যাটাস দিয়েছেন। করোনাকালে মানুষ নানা কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ পাননি অনেকে। তাঁরা ভার্চ্যুয়াল জগৎকে মতপ্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছেন। যতক্ষণ কেউ অন্যের অধিকার খর্ব করছে না, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে।
মামলার অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা কার্টুনিস্ট কিশোরের আঁকা কিছু কার্টুন ও স্ট্যাটাস জুড়ে দিয়েছেন। তাতে কোভিডের চিকিৎসায় ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতাল, শত শত সরকারি চিকিৎসকের বেতন না হওয়া, ‘ভোট চুরি’, ‘চাল চুরি’সহ নানা বিষয়ে কটাক্ষ ও মন্তব্য করেন।
লেখক মুশতাক সম্পর্কে অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, তিনি ‘ক্রোকোডাইল ফারমার’ নামে একটি ফেসবুক পেজ চালান। সেখানে তাঁর বিভিন্ন বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যের কথা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুলের বিরুদ্ধেও ফেসবুকে সরকার ও ভোটসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যের অভিযোগ আনা হয়েছে। সেসব মন্তব্য অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কিশোর, মুশতাক, দিদারুল তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। তাঁরা দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থা, অন্যায়, নির্যাতন ও সংবিধান স্বীকৃত অধিকার না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মত প্রকাশ করেছেন। এটা বাক্স্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *