টানা ৩০ দিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বেই চলছে ২০ দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি। প্রথম ১৬ দিন ছিলেন পুলিশি ব্যারিকেডে অবরুদ্ধ। তারপর পুলিশি অবরোধ তুলে নেয়া হলেও কৌশলগত কারণে কার্যালয় ছাড়েননি তিনি। এরই মধ্যে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন বিদেশে অবস্থানরত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। কার্যালয়ের সীমিত চলাফেরার মধ্যে যোগ হয়েছে শোক। পুত্রশোকে কাতর ও বিপর্যস্ত তিনি। এ অবস্থায় সর্বশেষ তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, টিভি, ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হলেও অন্যান্য সংযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন। যেকোন সময় গ্রেপ্তারের ঝুঁকিও রয়েছে।
কার্যালয়ে শোকার্ত পরিবেশে আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় দিন কাটছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। দিনের বেশির ভাগ সময়ে তার চারপাশে থাকেন স্বজনরা। চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, বড় ছেলে তারেক রহমানের শ্বশুর বাড়ি থেকে খালেদা জিয়ার প্রতিদিন খাবার আসে। নিজের বাসার একজন লোক সে খাবার নিয়ে আসে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জিয়া পরিবারে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া কখনও কখনও দুই ভাই সাঈদ এস্কান্দর ও শামীম এস্কান্দরের পরিবার থেকে খাবার আসে। তবে সে সব খাবার দুই ভাইয়ের বউ নিজেরা নিয়ে আসেন। খাবারের ব্যাপারে অনেক বেশি যাচাই-বাছাই ও নিয়ম রক্ষা করে চলেন খালেদা জিয়া। খাবার খান খুবই পরিমিত। সামান্য একটু ভাত এবং তার দ্বিগুণ সবজি, মাছ বা এক টুকরো মাংস। তবে বেশির ভাগ দিন তার খাবার মেন্যুতে থাকে করলা ভাজি। সবজির মধ্যে এটি তিনি খুবই পছন্দ করেন। তিনি প্রায়ই পেঁপের জুস ও তাজা ফলমূল খান। ফলমূলের মধ্যে থাকে- ডালিম, কালো আঙুর, পেয়ারা ও কমলা। তবে কোনটিই খুব বেশি নয়। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন থেকেই তিনি নিজের মতো করে একটি জীবনযাপন প্রণালী তৈরি করে নিয়েছেন। রাতে ঘুমোতে যান দেরিতে। সকালের নাস্তা ও চা খেয়ে তিনি কিছুক্ষণ দিনের পত্রপত্রিকাগুলোতে চোখ বোলান। এ সময় দলের কাজকর্মের কিছু কাগজপত্রও দেখেন। বেলা ১১টার দিকে তিনি ফের ঘণ্টা তিনেকের জন্য ঘুমান। বিকালে আবার বিভিন্ন কাগজপত্র দেখেন। বিকাল থেকে সন্ধ্যার পর দলের লোকজনের সঙ্গে নানা সাংগঠনিক বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া দলের সিনিয়র নেতা ও বিশিষ্টজনদের তিনি সাক্ষাৎ দেন। তাদের কাছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চান এবং আলোচনা করেন। অনেক সময় নেতাদের বিভিন্ন পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার জন্য কোন রান্নাবান্না হয় না। কিন্তু সেখানে অন্যদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা রয়েছে। কার্যালয় সূত্র জানায়, ৩রা জানুয়ারি অন্যান্য দিনের মতো কার্যালয়ে এসেছিলেন খালেদা জিয়া। ফলে সেখানে তার ঘুমানোর জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা ছিল না। কার্যালয়ের সামনে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়ার পর সেখানে আসবাবপত্র নেয়া যায়নি। খালেদা জিয়া নিজেও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে নিজের কক্ষে একটি জাজিমের ওপর ঘুমোচ্ছেন তিনি। তার কক্ষে অ্যাটাচড বাথরুম থাকলেও বাসার মতো সেগুলো বড় নয়। এ নিয়ে কিছুটা অসুবিধায় রয়েছেন তিনি। গুলশানের বাসায় দিনের কিছু সময় দোতলার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতেন খালেদা জিয়া। এছাড়া, বাসার কক্ষগুলো ছিল বড়। কিন্তু কার্যালয়ে তার কক্ষটি অনেক ছোট। ওই একটি কক্ষের মধ্যেই তার চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে।
ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর আগের অবরুদ্ধ দিনগুলো খালেদা জিয়ার জন্য ছিল একরকম। কিন্তু ছেলের মৃত্যুর পর থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন দিনের অনেকটা সময় তিনি জায়নামাজে পার করেন। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর তিনি খাবার নিয়ে বেশ অনিয়ম করেছেন। দুইদিন ভাতই মুখে তুলেননি। অনেক সান্ত্বনা দিয়ে ও বুঝিয়ে এ সময় তাকে কিছু হালকা খাবার ও পানীয় দিয়েছেন স্বজনরা। এতে তিনি শারীরিকভাবেও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। অনেকটা শুকিয়ে গেছেন। গত ৮ বছর ধরে একের পর এক বিপর্যয় পার করছেন তিনি। কারাবন্দি থাকাকালে মাকে হারিয়েছেন। দুই ছেলে ও তাদের সন্তানরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বাইরে। ভাই সাঈদ এস্কান্দরের পর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। ছেলের শোক তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
কার্যালয় সূত্র জানায়, ৩রা জানুয়ারি রাত থেকেই গুলশান কার্যালয়ে তার সঙ্গে অবস্থান করছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল ও কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। খালেদা জিয়াকে সহায়তা করার জন্য তার গৃহকর্মী কুলসুম রয়েছেন প্রথমদিন থেকেই। দিনের বেশির ভাগ সময় খালেদা জিয়ার কক্ষে তার সঙ্গে সময় কাটান আরাফাত রহমান কোকোর দুই মেয়ে, সাঈদ এস্কান্দর ও শামীম এস্কান্দরের স্ত্রী। মাঝে মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দেন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহীনা খান বিন্দুসহ জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনরা। কোন কোন দিন শামীম এস্কান্দরের স্ত্রী রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবস্থান করতেন। এখন দুই নাতনিই সে স্থান পূরণ করছেন। তবে বেশির ভাগ দিন আত্মীয়স্বজনরা সকালে গুলশান কার্যালয়ে যান, সারাদিন সঙ্গ দিয়ে রাতে বাসায় ফিরে যান। বেশির ভাগ সময় জরুরি প্রয়োজনে সেলিমা রহমান, শিরিন সুলতানা ও শিমুল বিশ্বাস তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় তাকে নানা তথ্য সম্পর্কে অবহিত করে, পরামর্শ ও নির্দেশনা নেন। কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ ব্যারিকেড তুলে নেয়ার পর দলের অনেক নেতাই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সেখানে গেছেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করেছে, গ্রেপ্তার নিয়ে শঙ্কিত নন খালেদা জিয়া। কারণ তিনি অতীতে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। আটক অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। এখনও এক অর্থে তিনি বন্দিজীবনই পার করছেন।