কাতারভিত্তিক আল জাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে ক’দিন ধরে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাসদর দপ্তর বিবৃতি দিয়ে নাকচ করেছে এ রিপোর্ট। মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য কথা বলেছেন এ নিয়ে। এসব প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার মিডিয়ায়। কিন্তু আল জাজিরার রিপোর্টের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেনি এসব মিডিয়া। কেন এই নীরবতা? অন্তত তিনটি সংবাদপত্র সম্পাদকীয় প্রকাশ করে এর কারণ জানিয়েছে-
প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে- কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা গত সোমবার বাংলাদেশ নিয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার বিষয়বস্তু এখন আর কোনো গোপনীয় ব্যাপার নয়। সংবাদমাধ্যমটি আগাম ঘোষণা দিয়ে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ শিরোনামের ভিডিও প্রতিবেদনটি প্রচার করেছে এবং এটি সমপ্রচারে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা কারিগরি বাধা সৃষ্টি না করায় জনগণ তা দেখতে পেরেছে।
সংগত কারণেই এ প্রতিবেদন নিয়ে নানা মহলে নানা আলোচনা হচ্ছে এবং জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে এ নিয়ে রাখঢাক রয়েছে এবং সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আকারে ইঙ্গিতে। এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক বাক?স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের পরিবেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
দেশের সংবাদমাধ্যমসহ সব মহলের মধ্যে যে একধরনের সেলফ সেন্সরশিপ বা স্ব আরোপিত বিধিনিষেধ কাজ করছে সেটা স্পষ্ট এবং এর কারণও আমাদের সবার জানা। সামপ্রতিক বছরগুলোতে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হয়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ক্রমাগত আঘাত এসেছে এবং সংবাদমাধ্যমসহ দেশের মানুষের ওপর ঝুলছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা। সবকিছু মিলিয়ে যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে, আল জাজিরার প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে সব মহলের সেলফ সেন্সরশিপে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে সরকার ও সেনাবাহিনীর তরফে দুটি প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। আইএসপিআরের তরফে বলা হয়েছে, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এ প্রতিবেদন কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের দেশকে অস্থিতিশীল করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অপপ্রয়াস মাত্র।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া অপর বিবৃতিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে একে লন্ডন ও অন্যান্য জায়গায় সক্রিয় উগ্রপন্থি ও তাদের সহযোগীদের উস্কানিতে বেপরোয়া ও নোংরা অপপ্রচার বলে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে জামায়াতে ইসলামীর মদতপুষ্ট কিছু সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপরাধী এবং কুখ্যাত ব্যক্তি তাদের চিরাচরিত ছকে যে ধরনের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালায়, এ রিপোর্টও সেই শ্রেণির। এরা বিভিন্ন উগ্রপন্থি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে আল জাজিরার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
এ দুটি প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় আল জাজিরার প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করা হলেও সেখানে যেসব প্রসঙ্গ ও বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলোর কোনো সরাসরি ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অথচ প্রতিবেদনে অর্থ পাচার, জাল পাসপোর্ট তৈরিসহ দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা প্রসঙ্গ রয়েছে। তবে ইসরাইল থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সামগ্রী কেনাসংক্রান্ত অংশ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে আইএসপিআরের বিবৃতিতে তা অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, হাঙ্গেরি থেকে কেনা সামগ্রীকে ইসরাইলের সামগ্রী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় ইসরাইল থেকে তা কেনার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা মনে করি, আল জাজিরার প্রতিবেদনটিতে আরো যেসব প্রসঙ্গ রয়েছে, সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হলে তা জনগণকে ভুল বার্তা দেবে। জনগণ যেহেতু প্রতিবেদনটি দেখেছে, তাই তাদের কাছে প্রতিটি প্রসঙ্গ পরিষ্কার করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া বিষয়গুলোর অনেক কিছু আগে থেকেই বিভিন্ন মহলে আলোচনায় ছিল।
আল জাজিরা একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং প্রতিবেদনটি ইংরেজি ভাষায় সমপ্রচারিত হওয়ায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দর্শকের কাছে তা পৌঁছেছে। এর একটি আন্তর্জাতিক দিক রয়েছে। ফলে আল জাজিরার প্রতিবেদনটিকে এককথায় প্রত্যাখ্যান করার কৌশল নেয়ার চেয়ে উত্থাপিত বিষয়গুলোর যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা তুলে ধরা বেশি জরুরি।
ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা ১লা ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’। দ্রুততার সঙ্গে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা একে মিথ্যা, মানহানিকর প্রচারণা বলে অভিহিত করেছে। বলা হয়েছে, চরমপন্থি ও তাদের মিত্রদের উস্কানিতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। দুটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর এই মন্ত্রণালয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তার একটি হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো’র এর সঙ্গে জড়িত থাকার একবিন্দু প্রমাণও নেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রতিবেদনের ঐতিহাসিক বর্ণনায় ‘১৯৭১ সালের ভয়াবহ গণহত্যার কথা উল্লেখ করতে পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে’।
আমরা মনে করি, আল জাজিরার রিপোর্ট সম্প্রচার অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সম্প্রচার বিঘ্নিত করতে বা বাধা দিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। এটা তাদের পরিপক্ব সিদ্ধান্ত। এমন অ্যাকশন নেয়া হলে সাধারণত তার উল্টো ফল হয়। অধিক পরিমাণ পাঠকের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বিদেশি মিডিয়ায় এমন সচরাচর হাঁটু-কাঁপানিয়া প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকাকে স্বাগত জানাই। তবে, প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের দেখানো প্রতিক্রিয়ায় অনুরূপ সুচিন্তিত পরিপক্বতা দেখানো হয়েছে বলে মনে হয়নি। প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এর জন্য সম্ভাব্য উস্কানিদাতা ও অর্থায়নকারীদের বিষয়ে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ জাতীয় প্রতিবেদন করায় আল জাজিরার উদ্দেশ্য নিয়েও সমালোচনা ও প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। তবে, আল জাজিরা যেসব বিষয়ে অভিযোগ তুলেছে, সে সব বিষয়ে কোনো বক্তব্য প্রতিবাদে স্থান পায়নি। দেশের মানুষ বাস্তবে এ বিষয়টি জানতে চায়।
সরকার কোন রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তা প্রকাশ না করে, কেবলমাত্র সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি। এখন পর্যন্ত আল জাজিরার প্রতিবেদন বা এর অংশবিশেষও আমরা প্রকাশ করিনি। এমনকি এই সম্পাদকীয় লেখার সময় আমরা প্রতিবেদনে উত্থাপিত কোনো অভিযোগ, কোনো ব্যক্তির নাম, ভিডিওতে প্রদর্শিত কোনো নথি, ভিডিওতে দেখানো ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে দণ্ডিত দুই পলাতক আসামির অংশগ্রহণ এবং ক্যামেরার সামনে বা পেছনে যেসব মানুষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করিনি।
আমরা মনে করি, আল জাজিরার রিপোর্টে উল্লেখ করা অভিযোগগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা কার্পেটের নিচে ময়লা চাপা দেয়ার মতো সমাধানে যাওয়া উচিত হবে না। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন, বিশেষ করে তার সংগ্রামের সময়গুলোতে। তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর কৃতজ্ঞতাবোধের পুরোপুরি সুযোগ নিচ্ছেন এবং আমাদের কিছু অতি সংবেদনশীল জায়গায় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য প্রভাব বিস্তার করছেন। ওই প্রতিবেদনে ইসরাইলের কাছ থেকে স্পর্শকাতর আড়িপাতার যন্ত্র কেনার রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। ইসরাইল হলো এমন একটি দেশ যাকে আমরা স্বীকৃতি দেইনি। এ ছাড়া ভুয়া পাসপোর্ট, এনআইডি কার্ড, ব্যাংক বিবরণীর কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। এসব বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন। কারণ এগুলোর পেছনে এমন সংস্থার নাম জড়িত, যাদের সততা ও নিরপেক্ষতার ওপর আমাদের নিরাপত্তা নির্ভর করে। আমাদের নিরাপত্তা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এবং তাদের নেতৃত্বের অধীনে রয়েছেন এমন নেতৃত্বের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব বিষয় সরকার এড়িয়ে গেলে তাতে শুধু বিপদ বাড়তে পারে।
পাঠকদের এটা জিজ্ঞেস করার পূর্ণ অধিকার আছে যে, কেন তারা স্থানীয় মিডিয়ায় এমন রিপোর্ট অনুপস্থিত দেখছেন? আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলছি, আমরা বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য বিষয় মিলে যে পরিবেশ, তার অধীনে কাজ করি। এটা তারই প্রতিফলন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্ভবত যেকোনো স্থানে মুক্ত মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিধিনিষেধযুক্ত এবং নিষ্পেষণমূলক আইন। পাঠকদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে, এখানে আমরা কারো নাম বা কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করিনি। যদি কেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এবং সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এবং প্রমাণহীন মানহানি মামলার দিকে দৃষ্টি দেন, যে গতিতে মামলাগুলো নেয়া হয়, তদন্ত করা হয়, আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়, কারাগারে পাঠানো হয় ও মাসের পর মাস জামিন না দিয়ে কারাবন্দি রাখা হয়- তাতেই সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়। এগুলো ছাড়াও ভয় দেখানো, হুমকি দেয়া এবং বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়াসহ অন্য আরো যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয় তা বলাই বাহুল্য। তারপরও আমাদের সত্য জানানোর সংগ্রামে সক্রিয় থাকতে হবে এবং সেটাই করছি।
প্রায় একই কারণ উল্লেখ করে আরো কিছু মতামত দিয়েছে ঢাকা ট্রিবিউন। এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, আল জাজিরা বিস্ফোরক বোমশেল বিশেষ অনুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রশ্ন উঠেছে- কেন বাংলাদেশি মিডিয়া এই অনুসন্ধান নিয়ে রিপোর্ট করেনি। কেন ওই প্রোগ্রামে উত্থাপিত বিস্ফোরক অভিযোগগুলো নিজেরা তদন্ত করছে না। এক্ষেত্রে ঢাকার মিডিয়ার নীরবতা হলো বৃত্তবন্দি এবং বধিরতা।
আমাদের এই নীরবতার কারণ খুবই সাধারণ। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে মানহানির মামলা এবং মিডিয়ার বর্তমান অবস্থা। অথবা বিষয়টি বিচার বিভাগ থেকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয় তার ওপর। এসব কারণে এই বিতর্কে কোনো অর্থপূর্ণ মন্তব্য করায় বাংলাদেশি মিডিয়াগুলোর সাহস দেখানো ঠিক নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইএসপিআর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবার পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে আল জাজিরার ওই রিপোর্টকে অপপ্রচার এবং হলুদ সাংবাদিকতা হিসেবে আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানানো হয়েছে। তারা যেমনটা সঠিক মনে করেছেন তাদের সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেয়ার অধিকার আছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। যদি কোনো পক্ষ মনে করে তাদের মানহানি হয়েছে তাহলে এমন আইনি ব্যবস্থা নেয়ার যথার্থ পূর্ণাঙ্গ অধিকার আছে।
অধিক উৎসাহের বিষয় হলো, আমরা লক্ষ্য করেছি যে, মিডিয়া আউটলেট ওই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়নি অথবা যে মিডিয়া চ্যানেলে এটা প্রচারিত হয়েছে তাও বন্ধ করে দেয়া হয়নি। অতীতে এমনটা হয়নি। এই রিপোর্ট বাংলাদেশি জনগণকে দেখার ও শোনার এবং এই রিপোর্ট প্ররোচনামূলক অথবা বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা যাচাই করার সুযোগ দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে আমরা অভিনন্দন জানাই। আমাদের মতে, পুরোটাই এমন হওয়া উচিত ছিল।
যদি কোনো রিপোর্ট অবিশ্বাসযোগ্য হয় অথবা বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি থাকে অথবা পক্ষপাতী হয় অথবা পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে তা পাঠক বা দর্শকদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারাই তখন ওই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করবেন এবং রিপোর্টে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা বানচাল করে দেবেন।
অন্যদিকে কোনো খবর যদি সীমা লঙ্ঘন করে, মিথ্যা প্রচার করে, মানহানি করে, তাহলে এমন নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হলো, এসব আইন কঠোরভাবে অনুশীলন ও কঠোরভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, যাতে জনগণের তথ্য জানার অধিকারে অকারণে হস্তক্ষেপ করা না হয়। এটা আমাদেরকে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় নিয়ে আসে।
সাদামাটা সত্য হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশি মিডিয়ার ওপর এক শীতল প্রভাব ফেলেছে। এতে এমন কিছু ভাষা আছে যার অধীনে ভয়াবহ পরিণতি গ্রহণের হুমকি রয়েছে। এ জন্য দায়িত্বশীল কোনো সম্পাদক বোধগম্য হলেও এমন কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করেন না, যা এর আওতায় পড়বে বলে মনে হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আদালত নির্দেশনা দিয়েছে যে, যখনই কোনো মামলা গ্রহণের বিষয় আসে তখন তারা আইনের অধীনে বিস্তৃত ব্যাখ্যা অনুসরণ করেন। কিন্তু রেকর্ড জোরালোভাবে বলে যে, আমাদের কঠোর বিচক্ষণতা এবং সতর্কতাও (কেউ কেউ বলতে পারেন এটা অতিমাত্রায়) এক্ষেত্রে অনর্থক।
কখনো কখনো এমন কিছু আছে যা দৃশ্যত নিরপরাধ সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হলে আইন প্রয়োগকারীরা পূর্ণ শক্তি নিয়ে একজনের পেছনে লেগে পড়েন। এটা মিডিয়ায় মারাত্মক ও শীতল এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এটাই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়, দেশের মানহানি বিষয়ক আইনও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর অধীনে আক্রান্ত একজনের পক্ষে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, যিনি আক্রান্ত হননি, তিনি মামলা করতে পারেন। এ ধরনের মামলায় বহু জুরিসডিকশন দেয়া হয়, যাতে কেউ একজন একই পক্ষের হয়ে বিভিন্ন আদালতে কয়েক ডজন মামলা করতে পারেন। এক্ষেত্রে যদিও তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক থাকে না।
এটা শুধু একটি কাল্পনিক পরিস্থিতি নয়, আইনে তত্ত্বীয়ভাবে অনুমোদিত, তবে কখনো কার্যকর হয় না। বার বার আমরা দেখেছি দূরের জেলাগুলোতে তৃতীয়পক্ষের হয়ে একটি পক্ষকে হয়রান করার জন্য মানহানির মামলা করছে। আর এসব মামলা গ্রহণ করছে আদালত।
আল জাজিরার রিপোর্টের ন্যায়পরায়ণতা বা ঘাটতি এখানে ইস্যু নয়। আমরা আগেই বলেছি, এ বিষয়ে সরকারের সহনশীলতার প্রশংসা করি আমরা এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়াও সঠিক। দেশের ভেতরকার মিডিয়ায় ওই রিপোর্টের কোনো জোরালো আলোচনার অভাব অথবা মন্তব্য এক অস্বস্তিকর সত্য।
সব সময়ই সংবাদপত্র এমন অবস্থান নিয়েছে, যাতে মিডিয়ার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা থাকে। প্রকৃতপক্ষে সেটা যেকোনো সরকারের স্বার্থেই। সরকারের ভাবমূর্তিতে এতবড় ক্ষতি আর কোনোকিছুতে হয় না, যা মিডিয়াকে দমন করার মাধ্যমে হয়।
বিশেষ করে আমরা মনে করি, যে সরকারের অনেক সফলতা ও অর্জন আছে, বর্তমানে অনেক কাজ চলছেও- তাদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দৃশ্যত, যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্ট হয়, তখন সরকার এ বিষয়টি স্বীকার করে। তাই আমরা আশা করি, দেশের ভেতরের মিডিয়ার পরিবেশের প্রতি সম্মান রেখে এমন আলোচনা এখনই শুরু করা যেতে পারে।